ক. হরিপুর রাজবাড়ি
ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজবাড়িটি আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রাসাদোপম অট্টালিকাটি নির্মিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন ঘনশ্যাম কুন্ডুর বংশধর রাঘবেন্দ্র রায় চৌধুরী আর সম্পন্ন করেন তারই পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। মুসলিম শাসন আমলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। তখন মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম মহিলা এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তাঁর বাড়ি মেদিনীসাগর গ্রামে। জমিদারির খাজনা দিতে হতো তাজপুর পরগনার ফৌজদারের নিকট। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন। ঘনশ্যামের পরবর্তী বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। এসময় তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। জগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সমাপ্তকৃত রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতার নকশা এবং পূর্ব দেয়ালের শীর্ষে রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণের চৌদ্দটি আবক্ষ মূর্তি আছে।
এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এই অট্টালিকাটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শনগুলো প্রাচীনত্বের বিবেচনায় খুব মূল্যবান না হলেও এ অঞ্চলের একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে এখনো মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে যায়। জগেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। সে সময়ে বৃটিশ সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সামন্তপ্রভুদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে খুশি করতে চাইতেন। জগেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীকে এই একই উদ্দেশে রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন সত্য। কিন্তু এই উপাধি প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভবত আরো একটি বিষয় কাজ করেছিলো। আর সেটি হলো তাঁর বিদ্যানুরাগ ও শিল্প সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে আগ্রহ। রাজর্ষি জগেন্দ্রনারায়ণ যেমন আকর্ষণীয় স্থাপত্য শৈলীর প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তেমনি তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাজর্ষির এই অনুরাগ শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে তা নয়, সমগ্র হরিপুরবাসীর মানসিক ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল দিকটিকেও তুলে ধরে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এই ধারায় যে আলোকিত জীবনের আকাঙ্ক্ষা সেদিন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিলো তা আজো অনেকটাই বহমান রয়েছে এই হরিপুরে। ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিব মন্দির এবং মন্দিরের সামনে নাট মন্দির রয়েছে। রাজবাড়িতে ছিল একটি বড় পাঠাগার যার অস্তিত্ব এখন নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহদরজা ছিল তাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ১৯০০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হলে হরিপুর রাজবাড়িও দু'টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। রাঘবেন্দ্র-জগেন্দ্র নারায়ণ রায় কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে নগেন্দ্র বিহারী রায় চৌঃ ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌঃ ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম ছোট তরফ।
অবস্থান: হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত
খ. হরিণমারী শিব মন্দির
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে উত্তর পশ্চিমদিকে হরিণমারী হাটের উপর শিবমন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরের ছাদ চারচালা পদ্ধতিতে নির্মিত। এটা বেশ খানিকটা বসে গেছে। মন্দিরটির বর্তমান উচ্চতা প্রায় ত্রিশ ফুট এবং আয়তন ১৪ ×১৪ ফুট। দক্ষিণ দিকে একটি দরজা আছে। দরজায় পোড়ামাটির ফলকে লতাপাতার নকশার সাথে বিভিন্ন মূর্তির প্রতিকৃতি ছিল। বর্তমানে সেগুলো ভেঙ্গে গেছে। মন্দিরের পূর্বদিকে বেশ বড় একটি পুকুর আছে। আনুমানিক চারশ বছরের পুরাতন হতে পারে মন্দিরটি।
অবস্থান:
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে উত্তর পশ্চিমদিকে হরিণমারী হাটের উপর শিবমন্দিরটি অবস্থিত।
গ. গোরক্ষনাথ মন্দির, কূপ ও শিলালিপি
নেকমরদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে ঠাকুরগাঁওয়ের আরো একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থান হলো গোরকই বা গোরকুই। আর এখানেই রয়েছে বিখ্যাত গোরক্ষনাথ মন্দির ও নাথ আশ্রম। কোনো কোনো ঐতিহাসিক গোরক্ষনাথকে নাথপন্থীদের ধর্মীয় নেতা মীননাথের শিষ্য বলে ধারণা করে থাকেন। গবেষকদের মতে, এই গোরক্ষনাথ কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়, গোরক্ষনাথ হলো নাথপন্থি সম্প্রদায়ের গুরু বা যোগীর উপাধি মাত্র। কেননা উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিম কামরূপসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে গোরক্ষনাথের নাম পাওয়া যায়। এছাড়া নেপালেও বৌদ্ধযোগী হিসেবে একজন গোরক্ষনাথের অস্তিত্বের কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
কোচবিহার রাজ সরকারের অনুমতিক্রমে খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদ কর্তৃক সংকলিত ‘‘কোচবিহারের ইতিহাস, প্রথম খন্ড’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ‘‘গোরক্ষনাথ কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম না হইয়া নাথপন্থি সম্প্রদায়ের কোন গুরু বা যোগি বিশেষের একটি উপাধি হওয়াই অধিকতর সঙ্গত বলিয়া অনুমতি হয়।’’ কিন্তু গোরক্ষনাথ যে ধর্মীয় উপাধি মাত্র এই যুক্তি অনেক পন্ডিত মেনে নেননি। নাথ উপাধি হতে পারে, কিন্তু পুরো গোরক্ষনাথই উপাধি নয়। গোরক্ষনাথ যে একজন ব্যক্তি তাতে বোধহয় কোনো সন্দেহ নেই। ‘মহাযানী’ বৌদ্ধধর্ম পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের মধ্যে বিলীন হওয়ার পর যে সহজিয়া ধর্মমতের উদ্ভব হয় তার সঙ্গে হিন্দু যোগবাদের সংমিশ্রণের ফলে এই নাথধর্মের সৃষ্টি। গুপি চন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রন্থে নাথধর্ম প্রসঙ্গে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেছেন; ‘‘বাঙলাদেশে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের ফলে এক নতুন ধর্মের পত্তন হয় এবং সেটাই হচ্ছে মীননাথ প্রবর্তিত নাথ ধর্ম।’’ নাথপন্থিদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ‘‘প্রাচীন নাথপন্থিগণের মতে মহাপ্রলয়ের শেষে একমাত্র ‘অলেখ নিরঞ্জন’ই অবশিষ্ট থাকেন এবং সিদ্ধ নাথগুরুগণ নিরঞ্জনের স্বরূপ বলিয়া কথিত হন’’ বর্তমানে নাথপন্থি সম্প্রদায়ের আলাদা অস্তিত্ব নেই। নাথ উপাধিধারী ব্যক্তিরা হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে কোনো প্রকারে তাদের প্রাচীন স্মৃতি রক্ষা করছে।
এই নাথপন্থি ধর্ম সম্প্রদায়ের গুরু গোরক্ষনাথের স্মৃতিবাহী গোরক্ষনাথ মন্দির ও আশ্রমটি রাণীশংকৈলের গোরকুইয়ের একটি মৃত নদীর তীরে উঁচু জমির উপর অবস্থিত। মন্দির চত্বরটিতে মোট ৫টি মন্দির রয়েছে। ৩টি শিব মন্দির ও ১টি কালিমন্দির ছাড়াও ১টি প্রধান মন্দির আছে যা নাথ মন্দির নামে পরিচিত। এই নাথমন্দিরটি দক্ষিণমুখিভাবে চত্বরের প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত। এর পেছনে অর্থাৎ উত্তর দিকে পাষাণ বাঁধানো একটি চৌবাচ্চার মতো নিচু স্থানের মধ্যস্থলে বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দিয়ে ঘেরা এক অলৌকিক ইদাঁরা বা কুয়ো আছে। কুয়োর একেবারে নিচু অংশটুকুও পাথর দিয়ে বাঁধানো। কিন্তু মাঝে একটি ছিদ্র আছে যা দিয়ে নিচ থেকে কুয়োতে পানি আসে। কুয়োর চারপাশে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে অনেক লোক পূণ্যস্নান করলেও কুয়োর পানি কমেনা। মন্দিরের উত্তর চত্বরে টিনের চাল বিশিষ্ট যে আশ্রম রয়েছে তার দরজায় একটি শিলালিপি বা ফলক ছিল। এই শিলালিপিটি বর্তমানে দিনাজপুর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আবু তালিবের মতে, এই শিলালিপিটি বাংলা অক্ষরে উৎকীর্ণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত শিলালিপিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম।
অবস্থান: রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নে অবস্থিত
পীরগঞ্জ উপজেলার জাবরহাট ইউনিয়নের হাটপাড়া নামক স্থানে টাঙ্গন নদীর বাঁকে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে যে রাজবাড়ির অস্তিত্ব অনুভব করা যায় তা রাজভিটা নামে বর্তমান মানুষের নিকট পরিচিত। এর সঠিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন। তবে অনুমান করা হয় এটি শেরশাহের সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এখানে শেরশাহ আমলের মুদ্রা পাওয়া যায়। একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে যার বর্ণগুলো অপরিচিত এবং শিলালিপিতে একটি উট, একটি ঘোড়া ও একটি শুকরের প্রতিকৃতি আছে। সাংবাদিক কাজী নুরল ইসলাম তাঁর 'পীরগঞ্জের ঐতিহাসিক রাজভিটা' নিবন্ধে এ সমস্ত তথ্য প্রদান করে বলেছেন-'এগুলোর সূত্র বিশ্লেষণ করা হলে ঐ স্থানে কোন আমলে কোন রাজার রাজভিটা ছিল এর সঠিক তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।'
রাজভিটায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ নেই- সবই মাটির গর্ভে। মাটি খুড়লেই ইট পাথর বের হয়ে আসে। বিভিন্ন ভবনের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। আর নদীর ভাঙনেও নানা আকৃতির প্রচুর ইট ও পাথর বেরিয়ে আসে। নদীর উপত্যকায় পড়ে আছে বহু পাথর ও প্রাচীন ইট। রাজ পরিবারবর্গ টাঙ্গন নদীকেই নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করত যা সহজে বোঝা যায়। রাজভিটা প্রায় ৫০০ মিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ। রাজভিটা থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে শেরশাহ আমলের পূর্ণিয়া সড়কের নিদর্শন আছে।
অবস্থান: পীরগঞ্জ উপজেলার জাবরহাট ইউনিয়নের হাটপাড়া নামক স্থানে অবস্থিত
রানীশংকৈল উপজেলার পূর্বপ্রান্তে কুলিক নদীর তীরে মালদুয়ার জমিদার রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি। টংকনাথের পিতার নাম বুদ্ধিনাথ চৌধুরী। তিনি ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ এবং কাতিহারে ঘোষ বা গোয়ালা বংশীয় জমিদারের শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত। নিঃসন্তান বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার কাশীবাসে যাওয়ার সময় সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং তাম্রপাতে দলিল করে যান যে তিনি কাশী থেকে ফিরে না এলে শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত এই জমিদারির মালিক হবেন। পরে বৃদ্ধ জমিদার ফিরে না আসার কারণে বুদ্ধিনাথ চৌধুরী জমিদারি পেয়ে যান। তবে অনেকে মনে করেন এই ঘটনা বুদ্ধিনাথের দু এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে।
রাজবাড়ি নির্মাণের কাজ বুদ্ধিনাথ চৌধুরী শুরু করলেও সমাপ্ত করেন রাজা টঙ্কনাথ। বৃটিশ সরকারের কাছে টঙ্কনাথ রাজা পদবী পান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। বর্তমানে রাজবাড়িটির অনেক অংশই নষ্ট হয়ে গেছে। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে সিংহদরজা। দরজার চূড়ায় দিক নির্দেশক হিসেবে লৌহদন্ডে S.N.E.Wচিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। রাজবাড়ি সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারিবাড়ি। পূর্বদিকে দুটি পুকুর। রাজবাড়ি থেকে প্রায় দু'শ মিটার দক্ষিণে কুলিক নদীর তীরে রাস্তার পূর্বপ্রান্তে রামচন্দ্র (জয়কালী) মন্দির। এই মন্দিরটি রাজবাড়ির চেয়ে প্রাচীন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনারা মন্দিরটির ক্ষতি সাধন করে। এখন এটা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
অবস্থান: রাণীশংকৈল উপজেলা সদর থেকে ১ কি:মি: দূরে অবস্থিত
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে জগদল নামক স্থানে নাগর ও তীরনই নদীর মিলনস্থলে ছোট একটি রাজবাড়ি রয়েছে। রাজবাড়িটির সম্ভাব্য নির্মাণকাল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। বর্তমানে রাজবাড়িটি প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়ি থেকে প্রায় একশ মিটার পশ্চিমে নাগর নদীর পাড়ে মন্দির ছিল যা আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। জগদলের রাজকুমার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্র কুমার। তাঁর সঙ্গে বাকীপুরের জমিদার রায় পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের পুত্র শ্রী নলিনী রঞ্জনের কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতি আশালতা দেবীর বিয়ে হয়। শ্রী বীরেন্দ্র কুমার সুশিক্ষিত ছিলেন। বইয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। এ কারণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ পাঠাগার । তৎকালীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ - বর্তমান দিনাজপুর সরকারি কলেজে ১৯৪৮ সালে তাঁর পাঠাগারের বইগুলো দান করা হয়, যার মূল্যমান ধরা হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা।
অবস্থান: রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে জগদল নামক স্থানে অবস্থিত
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে মীরডাঙ্গী থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে মহেশপুর গ্রামে মহালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহের আমলে এটি প্রতিষ্ঠিত। দিনাজপুর জাদুঘরে শিলালিপিটি সংরক্ষিত ছিল। শিলালিপি সূত্রে জানা যায় মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মিয়া মালিক ইবনে জুযমদার। এটি ছিল তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদে ভূমি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু চারদিকে শিলা প্রাচীর ছিল। যে শিলাগুলো থাম হিসেবে ব্যবহৃত সেগুলো নকশা করা। শিলা-প্রাচীরের উপরে নির্মিত হয় ইটের দেয়াল। ছাদেও শিলাখন্ডের ব্যবহার ছিল। ছাদ থেকে পানি বের করে দেয়ার জন্য খোদিত শিলার ব্যবহার দেখা যায়। ১৯৭১ সালের পূর্বেই মূল মসজিদটি ধ্বংস হয় এবং সেখানে নির্মিত হয় নতুন মসজিদ। নবনির্মিত মসজিদটির ভিত ও মেঝেতে প্রাচীন মসজিদের পাথর এবং দেয়ালে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মসজিদের কাছে নকশা করা ও নকশাবিহীন বেশকিছু শিলাখন্ড পড়ে রয়েছে। প্রাচীন মসজিদের নকশা করা প্রায় ৩৬ ×৩০ ইঞ্চি আয়তনের শিলাখন্ড নতুন মসজিদের মিহরাবে আটকানো আছে। এছাড়া প্রাচীন মসজিদের তিন তাকের নকশা করা শিলাখন্ডের মিম্বারটি এখনো নতুন মসজিদের সামনে পড়ে রয়েছে।
মসজিদের পূর্বপাশে আছে একটি ছোট দিঘি। দিঘিটির উত্তর পাড়ের ঘাট উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পাথরে বাঁধানো। মসজিদের দুশ মিটার পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে দুটি কবর। কবর দুটি একসঙ্গে ইট দিয়ে বাঁধানো। কবরের উত্তর-পশ্চিমের কোণে নকশা করা একটি পাথরের থাম রয়েছে। হয়তো কবরের চারকোণেই এ ধরনের থাম ছিল। কবর দুটির মধ্যে একটি 'বিশ্বাস পীরের' মাজার বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত। সম্ভবত বিশ্বাস শব্দটি ক্রমান্বয়ে বিশওয়াশ থেকে বিশ বাইশ শব্দে বিকৃত হয়েছে। ফলে এলাকাটিকে বলা হয় বিশবাইশ মহাল।
অবস্থান: ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে মীরডাঙ্গী থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে মহেশপুর গ্রামে অবস্থিত।
রাণীশংকৈল উপজেলা হতে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে নেকমরদ স্থানটির মূল নাম ছিল ভবানন্দপুর।শেখ নাসির উদ-দীন নামক এক পূন্যবান ব্যক্তি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভবানন্দপুর আসেন। তিনিই পীর শাহ্ নেকমরদ নামে খ্যাতিমান এবং তার নাম অনুসারেই ভবানন্দপুর পরবর্তীতে নেকমরদ নামে পরিচিতি লাভ করে। নেকমরদ বাজারের পূর্বদিকে পীর শেখ নাসির-উদ-দীন নেকমরদের মাজার। তার সম্পর্কে জনশ্রুতি ছাড়া সঠিক ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা হয় সুলতানি তাঁর আগমন ঘটে। পীর শাহ নেকমরদ সম্পর্কে আছে নানান ধরণের চমকপ্রদ কিংবদন্তী। নেকমরদ এলাকাটি প্রত্ন উপকরণের সমৃদ্ধ। পীর শাহ নেকমরদের মাজার প্রত্ন উপকরণের মাঝে প্রতিষ্ঠিত বলে কিংকদন্তীর কাহিনী আরো জোরালো যেমন হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগে ভীমরাজ ও পীতরাজ নামে দুইভাই এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তাদের শাসন আমলে প্রজা সাধারণ ছিল নির্যাতিত। অনাচার, দুর্নীতি আর অরাজকতায় মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। এমন দুঃসময়ে শেখ নাসির উদ্দিন নেকমরদ এই রাজ্জে প্রবেশ করেন। ভীমরাজ ও পীতরাজ কৌশল তাকে বাধা দিলে তিনি অলৌকিক ক্ষমতা বলে সেই বাধা ছিন্ন করেন।বিরক্ত হয়ে অত্যাচারী দু ভাইকে অভিশাপ দিলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের রাজধারীর ধ্বংসাবষের উপরনীরমিত হয় পীর শাহ নেকমরদের আস্তানা বিধ্বস্ত রাজধানীর উপর শুরু হয় নতুন জনপদের যাত্রা। পীর শাহ নেকমরদ পহেলা বৈশাখে ইন্তেকাল করেন। তার পূর্ণ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে এই তারিখে পবিত্র ওরস উদযাপন ও বার্ষিক মেলার প্রর্বতন হয়। এই মেলাই হচ্ছে বিখ্যাত নেকমরদ মেলা।পীর শাহ নেকমরদের মাজারটি সম্পূর্ণ কাঁচা ছিল। মাজারের কারুকার্য খচিত চাঁদোয়া এবং জামে মসজিদটি প্রায় আশি বছরপূর্বে নির্মিত হয়।
কিভাবে যাওয়া যায়:
রাণীশংকৈল উপজেলা হইতে উত্তরে হাইওয়ে রাস্তা ১০কি:মি: পরে নেকমরদ । রাণীশংকৈল হতে বাস, অটোরিক্সা যোগে নেকমরদ যাওয়া যায়। নেকমরদ চৌরাস্তার পূর্বে মাজার শরীফটির অবস্থান।
অবস্থান: নেকমরদ চৌরাস্তার পূর্ব পার্শে মাজার শরীফটির অবস্থান।
ঝ. সনগাঁ শাহী মসজিদ
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কালমেঘ হাট থেকে দু কিলোমিটার উত্তরে সনগাঁ নামক গ্রামে সনগাঁ মসজিদটি নির্মিত। মোঘল সম্রাট শাহ আলমের সময় এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মসজিদে তিনটি গম্বুজ ও তিনটি দরজা আছে। দক্ষিণে একটি পাকা কূপ আছে। কূপের গায়ে পোড়ামাটির বাংলালিপি রয়েছে। তবে লিপিটি অস্পষ্ট হওয়ায় পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মসজিদের পূর্বপাশে প্রাচীন কবর আছে। এখানেই শুয়ে রয়েছেন 'সুধিবাদ পীর' নামক এক পূণ্যাত্মা।
অবস্থান:
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কালমেঘ হাট থেকে দু কিলোমিটার উত্তরে সনগাঁ নামক গ্রামে অবস্থিত
ঞ. ফতেহপুর মসজিদ
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে প্রায় সাত কি.মি. পশ্চিমে মোড়লহাটের সন্নিকটে ফতেহপুর মসজিদ । এটি মোগল আমলে নির্মিত । মসজিদে তিনটি গম্বুজ আছে। চারকোণ চারটি অর্ধ নিমগ্ন কৌনিক থাম রয়েছে যার নিচের অংশে ঘড়ার নকশা আছে। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিমে দেয়ালে আছে দুটি করে চারটি থাম । মসজিদটিতে ছয় ফুট উচ্চতার একটি দরজা আছে। কিন্তু মসজিদটিতে কোনো মিহরাব নেই তবে মিহরাবের ফ্রেম রয়েছে। এর বাইরের আয়তন দৈর্ঘ্যে ত্রিশ ফুট ছয় ইঞ্চি এবং পস্থেতের ফুট ছয় ইঞ্চি । ভিতরের প্রশস্থতা এক কাতারে নামাজ পড়ার মত।
ত. জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জহাট। হাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ। মসজিদ অঙ্গনে প্রবেশমুখে বেশ বড় সুন্দর একটি তোরণ রয়েছে। তাজপুর পরগনার জমিদারবাড়ি থেকে রওশন আলী নামক এক ব্যক্তি এ অঞ্চলে আসেন। তাঁরই বংশধররা পরবর্তীতে এখানে জমিদারী পান। ১৮৬২ সালে জমিদারবাড়ির ভিত্তি স্থাপন করা হয়। বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৮৬৭ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফলে মসজিদের ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও জমিদার বাড়িটির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়।
মসজিদটির শিল্পকলা দৃষ্টিনন্দিত, মনোমুগ্ধকর ও প্রশংসাযোগ্য। মসজিদে বড় আকৃতির তিনটি গম্বুজ আছে। গম্বুজের শীর্ষদেশ কাচ পাথরের কাজ করা। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মিনারগুলো। মসজিদের ছাদে আটাশটি মিনার আছে। একেকটি মিনার ৩৫ ফুট উঁচু এবং প্রতিটিতে নকশা করা রয়েছে। গম্বুজ ও মিনারের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য। এত মিনার সচরাচর কোন মসজিদে দেখা যায় না। মসজিদটির চারটি অংশ হলো মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদসহ বারান্দা, ছাদবিহীন বারান্দা এবং ছাদবিহীন বারান্দাটি অর্ধ প্রাচীরে বেষ্টিত হয়ে পূর্বাংশে মাঝখানে চার থামের উপর ছাদ বিশিষ্ট মূল দরজা। খোলা বারান্দার প্রাচীরে এবং মূল দরজার ছাদে ছোট ছোট মিনারের অলংকার রয়েছে। মূল কক্ষের বাইরের দিক থেকে পরিমাপ হচ্ছে ২৯×৪৭ ফুট এবং ছাদবিহীন বারান্দার পরিমাপ ২১×৪৭ ফুট। মূল কক্ষের কোণগুলো তিন থাম বিশিষ্ট। এর জানালা দুটি, দরজা তিনটি, কুলুঙ্গি দুটি। মসজিদটির ভিতরে দরজায়, বারান্দায় এবং বাইরের দেয়ালগুলোতে প্রচুর লতাপাতা ও ফুলের সুদৃশ্য নকশা রয়েছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের হংসরাজ এবং তার পুত্র রামহিৎ মসজিদটির মূল কারিগর। দ্বারভাঙ্গা এলাকার কারিগরেরাও নির্মাণ কাজে অংশ নেয়।
অবস্থান: ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জ হাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত
ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে শালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি বাংলা ১২১৫ সালে তৈরি হয়েছে। সংস্কারের কারণে মসজিদটির মূল নকশা নষ্ট হয়ে গেছে। শালবাড়ি মসজিদটির অদূরে ভগ্নদশার একটি ইমামবাড়া আছে। এটাও মসজিদটির সমসাময়িক বলে অনুমান করা হয়। ইমামবাড়াটির পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে দুটি করে চারটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দুটি দরজা আছে। এর বাইরের পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ঊনিশ ফুট ছয় ইঞ্চি এবং প্রস্থে তের ফুট। এখানে মহরমের অনুষ্ঠানাদি হতো।
অবস্থান: ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে অবস্থিত
শতবর্ষাধিক পুরাতন এ মসজিদটি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলাধীন ছোট বালিয়া গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটির নির্মাণশৈলীতে মোঘল স্থাপত্যের নান্দনিকতা পর্যটকদের যেমন বিমোহিত করে, তেমনি তুলে ধরে ঠাকুরগাঁও-এর ঐতিহ্যকে। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে মাত্র ১৮ কি.মি. দুরে অবস্থিত এ ঐতিহাসিক মসজিদটি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটি অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস