ঠাকুরগাঁও এর ব্যবসা ও বানিজ্য
মুক্তিযুদ্ধ উত্তর ঠাকুরগাঁও এর অর্থনীতিতে সবচাইতে বড় পরিবর্তন হচ্ছে কৃষি এবং অকৃষি উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের সুযোগ। যদিও দুর্ভাগ্যজনক, দিক নির্দেশনাবিহীন অর্থনীতির কারণে এদেশে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ায় ভূমিহীনের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এতদসত্বেও মানুষের শ্রম, উদ্ভাবন ও বিরামহীন প্রচেষ্টা নুন্যতম বেঁচে থাকার অবস্থানকে সমৃদ্ধ করেছে। স্বাধীনতা উত্তর তৎকালিন সরকারের নুন্যতম জমির সিলিং ব্যবস্থা বাংলাদেশের ভুমি সংস্কারের ক্ষেত্রে, ভুমি অর্থনীতির ক্ষেত্রে এবং দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভূমি সংস্কার বাস্তবে কার্যকর না হওয়ার ফলে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি।
কৃষি নির্ভর ঠাকুরগাঁও এর অর্থনীতিতে স্বাধীনতা উত্তর কালে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি গুলো হচ্ছে উত্তর বাংলাদেশ গভীর নলকুপ প্রকল্পের সেচ ব্যবস্থার (যা গত ৮/০১/০৩ থেকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত) মাধ্যমে একই জমিতে তিন ফসল পর্যন্ত উৎপাদন, শস্য বহুমুখি করণের মাধ্যমে কৃষি খাতকে ধীরে ধীরে লাভজনক করা এবং এ ক্ষেত্রে Cash Crop হিসাবে আলু, ভুট্টা ও তরমুজের ব্যপক উৎপাদন, গম চাষে কৃষকদের ঈপ্সিত সাফল্য, ব্যাপক হারে সবজী চাষ এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ। এর ফলশ্রুতিতে কৃষি অর্থনীতিতে নিঃ সন্দেহে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সত্য তবে বাজার ব্যবস্থার দূর্বলতা এবং কার্যকর বিপনন ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনের তুলনায় কৃষকের ঘরে মুনাফা উঠছে না।
ঠাকুরগাঁও এর কৃষি অর্থনীতির আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক বাণিজ্যিক ভাবে ফল উৎপাদন। বিশেষ করে আম এবং লিচুর ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক উৎপাদান এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনের ধারাকে আরো বৈচিত্র্যমুখী করে তুলেছে। পুকুরে মৎস্য চাষ এবং গবাদি পশুপাখির ব্যাপক উৎপাদনের মাধ্যমেও এ অঞ্চলের লড়াকু মানুষেরা কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক অবদান রাখছে।
শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং এক সময়ের ঠাকুরগাঁও জেলার অহংকার ঠাকুরগাঁও চিনিকল এখন ঠাকুরগাঁও বাসীর বোঝা। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লোকসানের বোঝা নিয়ে পরিচালিত ঠাকুরগাঁও চিনি কলের এই করুণ হাল শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীদের চাকরি জীবনকেই ঝুঁকিপূর্ণ করেনি এ অঞ্চলের আখের মত প্রাচীনতম কৃষি পণ্যের উৎপাদনের প্রতি আগ্রহকেও অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। দূর্নীতি, জবাবদিহিতার অভাব, অপ্রয়োজনীয় কর্মী এবং বাই প্রডাক্ট ভিত্তিক শিল্প কারখানা না থাকায় চিনি কলটির এই করুণ হাল। একই পরিণতির দিকে এগিয়ে যেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানা। ১৯৭৫ সালে আরডিআরএস এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রেশম কারখানাটি ১৯৮১ সালের ১ লা জুলাই সরকার অধিগ্রহণের পর ৩০/১২/২০০২ তারিখে সাত কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। দুর্নীতি, মূলধনের অভাব আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং সবগুলো ইউনিট চালু না থাকার কারণে বন্ধ হয়ে যায় এ অঞ্চলের অর্থনীতির সবচাইতে সম্ভাবনাময় রেশম কারখানাটি। বেগম রোকেয়া আজ থেকে একশত বছর আগে ১৯০৫ সালে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সবচাইতে কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে এন্ডি শিল্পকে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর ভাষায় ‘‘এত অল্প মুলধনে যে ব্যবসা পরিচালনা করা যায় তাহার প্রতি আমাদের মনযোগ আকৃষ্ট হয় না, ইহার অপেক্ষা আর দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে।’’ ৩৮ রেশম কারখানাটি বন্ধ হওয়ার ফলে ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামেগঞ্জে যে দুঃস্থ নারীরা গুটিপোকার চাষ করত তাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে।
কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপনে ঠাকুরগাঁও এ কাজী ফার্মস গ্রুপ বর্তমানে পথিকৃত হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে ঠাকুরগুঁাও জেলায় কাজী হ্যাচারী প্রতিষ্ঠার পর ইতিমধ্যে প্যারেন্টস ফার্মস, গ্রান্ড প্যারেন্টস ফার্মস হ্যাচারী ও ফিড মিল প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের সম্ভবনাময় কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলছে। এই ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে ফুড ইন্ডাষ্ট্রি, চট উৎপাদন কারখানা, শ্লটার হাউজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার ফলশ্রুতিতে উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিপণন ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও, ইতিমধ্যে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠছে চা বাগান। ইতিমধ্যেই জেলায় বাম্পার হারে উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ ও বিপণন নিশ্চিত করার প্রয়োজনে অনেকগুলো হিমাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ১০৪টি শিল্প প্লট নিয়ে ১৫ একর জমিতে ১৯৯৩ সাল থেকে ঠাকুরগাঁও এ বিসিক এর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৫৬টি প্লট বরাদ্দ হলেও ১৩টি শিল্প কারখানা চালু হয়েছে আবার ৩টি কারখানা বন্ধ হয়েগেছে। ঠাকুরগাঁও এর শিল্পায়নে বিসিক শিল্প নগরী এ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেনি। তবে বিসিক শিল্প নগরীতে স্থাপিত ফুড ইন্ডাষ্ট্রি, প্লাষ্টিক ও চট কারখানায় কিছুটা সাফল্য এনেছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে শিল্পায়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে কৃষি ভিত্তিক শিল্প (দুধ, খাদ্য, রেশম, কৃষি পণ্য) গড়ে উঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা বিরাজ করছে। সবচাইতে আশার কথা এলক্ষে, কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। যা আগামী একদশকে পাল্টে দিতে পারে ঠাকুরগাঁওয়ের অর্থনীতির চালচিত্র।
ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই অঞ্চলের কর্মরত এনজিও’দের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। দরিদ্রতা বিমোচন বিশেষতঃ দরিদ্র নারী পুরুষের আয় ও কর্মসংস্থানে ইএসডিও ও আরডিআরএস ইতিমধ্যেই ঠাকুরগাঁওয়ের সর্বস্তরের মানুষের প্রসংশা কুড়িয়েছে। বিশেষতঃ স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরেই আরডিআরএস’র ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম এবং ৯০’র দশক থেকে ইএসডিও’র ক্ষুদ্র ঋণ, শিশুশিক্ষা ও সাক্ষরতা এবং সমন্বিত সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম এ-জেলার দরিদ্র ও অতি দরিদ্র মানুষের বিশেষতঃ দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া সামাজিক সচেতনতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্ষেত্রেও এনজিও’দের ইতিবাচক পদক্ষেপ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে।
প্রশাসনিক পুর্ন©র্বন্যাসের ধারায় ১৯৮৪ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় পরিণত হয়। নবগঠিত জেলার সুবিধা হিসাবে সরকারী সাহায্য সহযোগিতা এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপকভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় জেলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে সরকারের যে দপ্তরটির কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এলজিইডি’র সহায়তায় ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে পাকা রাস্তা। ফলশ্রুতিতে উৎপাদিত পণ্য বিপণনে অধিক সুবিধা মানুষের আয় বাড়িয়েছে এবং স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৮ সালে যমুনা ব্রিজ চালু হওয়ার ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত পরিবর্তন না হলেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস