প্রাগৈতিহাসিক কালে সমুদ্রগর্ভে ছিল বাংলাদেশ নামের এই বদ্বীপটি। বিপুল জলরাশিতে নিমজ্জিত এই ভূখন্ডটি কালপ্রবাহে জেগে ওঠে। তবে এর যে এলাকাটি সমুদ্রের তলদেশ থেকে সবার আগে উঠে আসে তাহলো, হিমালয়ের পাদদেশ ও তার সংশ্লিষ্ট অঞ্চল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষকরে বৃহত্তর দিনাজপুরের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্র গর্ভের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে তাই অনেক আগে। আর এজন্যই এই এলাকার মানুষ সভ্যতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে অপেক্ষাকৃত আগে থেকেই। তাই প্রাচীন সভ্যতার কোনো নিদর্শন যদি খুঁজে পেতে চাই তাহলে তার সন্ধান করতে হবে প্রাচীন জনপদ ঠাকুরগাঁও ও সংলগ্ন এলাকাতেই। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের কাছাকাছি নেপালের রাজদরবার থেকে। নিশ্চয়ই নেপালীরা চর্যাপদের পদ রচনা করেন নি, রচনা করেছেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এবং তা অবশ্যই সংলগ্ন এলাকার কোনো মানুষ। কেননা সে সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিলনা বলে দূরের কোনো কিছু পাওয়া বা সংগ্রহ করা দুস্কর ছিল। তাই চর্যাপদ যে নেপালেরই কাছাকাছি কোনো বাংলা ভাষাভাষী এলাকার সম্পদ তাতে বোধহয় সন্দেহ থাকার কথা নয়। আবার দেখা যায় যে, ঠাকুরগাঁও ও সংলগ্ন এলাকার মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে চর্যাপদের ভাষার যথেষ্ট মিল রয়েছে। চর্যাপদে বর্ণিত সমাজচিত্র থেকে এবং এলাকার বর্ণনা থেকে অনেক কিছুই পাওয়া যায় যার কারণে একে ঠাকুরগাঁও ও আশে-পাশের অঞ্চলের পদকারদের সৃষ্টি বলে ধরে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়না। এছাড়া গোরক্ষনাথ বলে চর্যাপদের যে পদকর্তা রয়েছেন তাঁর সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ের সংশ্লিষ্টতা অনেকেই সমর্থন করেছেন। তথ্য প্রমাণের স্বল্পতার কারণে চর্যাপদের সঙ্গে ঠাকুরগাঁও ও সংলগ্ন এলাকার সম্পর্কটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধান করা সম্ভব হলে অনেক তথ্য প্রমাণ সংগৃহীত হবে এবং তখনই এ ব্যাপারে যে সংশয় রয়েছে তা দূর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।ঠাকুরগাঁও ও সন্নিহিত এলাকাকে চর্যাপদ রচনার এলাকা বলে রাষ্ট্রীয়ভাবেও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ঠাকুরগাঁও সম্প্রচার কেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে তদানীন্তন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্যরূপের প্রথম প্রকাশও ঘটে ঠাকুরগাঁও এবং এর সন্নিহিত অঞ্চলে। এই ভূমিতেই রচিত হয়েছিল চর্যাপদের কয়েকটি পদ’’। কাজেই ঠাকুরগাঁও যে সুপ্রাচীন ইতিহাসে সমৃদ্ধ একটি জনপদ তা বলতে বোধহয় কোনো দ্বিধাই নেই।
ইতিহাস সমৃদ্ধ এই জনপদটিতে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার বহু মূল্যবান সম্পদ। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সভ্যতার অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শনে পরিপূর্ণ ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন অঞ্চল। এখানে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছে অজস্র প্রত্নসম্পদ। মাটি খুঁড়লেই এখানে এখনো পাওয়া যায় প্রাচীন অট্টালিকার ধবংসাবশেষ সহ বহু মূল্যবান পুরাকীর্তি। কিন্তু পরিকল্পিত সংরক্ষণ, অধ্যয়ণ ও গবেষণা কাজের অভাবে বাংলার প্রাচীনতম জনপদ পুন্ড্র-বরেন্দ্রর কেন্দ্রস্থল ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাস আজো অনাবিষ্কৃত আছে। আর্য আগমনের বহু আগে থেকেই এই ঠাকুরগাঁও অঞ্চলসহ সমগ্র বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ছিল সভ্য মানুষের বসবাস। আর এই অনুমান যে অযৌক্তিক নয় তার প্রমাণ হলো, অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে বা কোটিবর্ষে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের গঙ্গারামপুরে) প্রস্তর যুগের বহু নিদর্শন প্রাপ্তি। এছাড়া অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার অংশ এবং ঠাকুরগাঁওয়ের কাছাকাছি অবস্থিত কোটিবর্ষের সঙ্গে ভূমিগত দিক থেকে এ এলাকার কোনো তফাৎ নেই। সেখানে যদি প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে তবে স্বাভাবিকভাবেই ঠাকুরগাঁওয়েও এ ধরণের প্রত্নবস্ত্ত পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এখনো ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে পুকুর-দিঘি খননের সময় অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে পাথরের বুদ্ধ মূর্তি ও বিষ্ণু মূর্তির সংখ্যাই বেশি। ১৯৮৪ সালে ঠাকুরগাঁও সদর থানার রাজাগাঁও গ্রাম থেকে কিছু প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে ২১টি প্রাচীন মুদ্রা স্থানীয় ট্রেজারিতে জমা করা হয়। মুদ্রাগুলোতে যে লিপি খোদিত আছে তার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও অনেকে অনুমান করছেন, মুদ্রাগুলো বৌদ্ধ কিংবা সুলতান আমলের। কিন্তু দু:খের বিষয় এই যে, মূল্যবান এই প্রাচীন মুদ্রাগুলো সম্পর্কে পরবর্তীতে আর কিছু জানা যায়নি। উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়নি এর গর্ভে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে। তাই বলা যেতে পারে যে ছড়িয়ে থাকা ও লুকিয়ে থাকা প্রত্ন সম্পদের উদ্ধার কাজের অভাবে এবং প্রত্নকীর্তির সংরক্ষণ, অধ্যয়ন ও গবেষণা কাজের অভাবে ঠাকুরগাঁওয়ের সাংস্কৃতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের সঠিক তথ্য আজো পুরোপুরি উদঘাটিত হয়নি। ফলে ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাস আজো রয়েছে অন্ধকারের গহবরে। তবুও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বিক্ষিপ্তভাবে ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজ কিছু হয়েছে বলেই ঠাকুরগাঁওয়ের নিকট অতীতের বিক্ষিপ্ত ইতিহাসকথা শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। তবে তার সবটাই অসম্পূর্ণ, বিচ্ছিন্ন ও জনশ্রুতি নির্ভর।
আনুমানিক চার হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে আর্যদের আগমন ঘটে। তবে বাংলাদেশে আর্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় মাত্র ২২০০ বছর আগে। আর তা ঘটেছিলো সম্রাট অশোকের মাধ্যমে। সম্রাট অশোকের আগে কোনো আর্যশক্তি বাংলাদেশ অধিকারে সক্ষম হয়নি। কিন্তু যদি অশোককে আর্য বলে না ধরা হয় তবে বাংলার মাটিতে আর্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে গুপ্ত আমলের। সম্রাট অশোক যে পুন্ড্ররাজ্য অধিকার করেছিলেন মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মিক্ষিলিপিতে খোদিত শিলাখন্ডলিপি, ছাঁচে ঢালা ও ছাপযুক্ত মুদ্রা (Punch marked and cast coin) এবং এন.বি.পি পাত্রে তা প্রমাণ পাওয়া যায়। ঠাকুরগাঁওসহ বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় অশোকের আমলের কোনো প্রত্নকীর্তির চিহ্ন আজো পাওয়া যায়নি। তবে ঠাকুরগাঁও যে তদানীন্তন পুন্ড্ররাজ্যের অংশ ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অশোকের পরে বেশ কয়েকশ’ বছরের ইতিহাসের হদিস পাওয়া যায়না।
গুপ্তদের ইতিহাস সুস্পষ্ট। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে পুন্ড্ররাজ্য তথা বাংলাদেশ গুপ্তদের অধিকারে আসে। সে সময়ে দিনাজপুরের কোটিবর্ষ ছিল পুন্ড্ররাজ্য তথা বাংলাদেশের একটি বিষয়ে সদর দপ্তর। আর একটি বিষয়ে কেন্দ্রস্থল ছিল পঞ্চনগরী। এই পঞ্চনগরীর অবস্থান বর্তমান দিনাজপুর জেলার চরকাই, বিরামপুর, চন্ডীপুর ও গড় পিঙ্গলাই এলাকায় বলে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন। গুপ্ত আমলের বেশ কিছু তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে বর্তমান দিনাজপুর জেলা থেকে। ফুলবাড়ি থানার দামোদরপুরে পাঁচখানা এবং হিলির বৈগ্রামে একখানা তাম্রলিপি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বৈগ্রামের তাম্রলিপিটি বেশ প্রাচীন। এটি সম্রাট কুমার গুপ্তের সময়ের (৪৪৭-৪৮ খ্রি:)। ঐতিহাসিক আ.কা.মো যাকারিয়া দিনাজপুর জেলায় গুপ্ত আমলের প্রাচীন কীর্তির নিদর্শন সমৃদ্ধ এলাকার নাম উল্লেখ করতে গিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল থানার নেকমরদের নামও উল্লেখ করেছেন। এ থেকে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলায় গুপ্ত আমলের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস