নদী মেখলা প্রকৃতি দুলালী এই বাংলাদেশে সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে লোক সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। আজ অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে সভ্যতার চরম বিকাশ হওয়ার সাথে সাথে বাংলার পল্লী জীবনের জীবনযাত্রা পদ্ধতিতে, আচার-অনুষ্ঠানেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। কিন্তু এতদসত্বেও তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই দেশ কৃষির- এই দেশ কৃষকের। এখনও দিনান্তে শ্রান্ত ক্লান্ত কৃষকের ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে সোনাভানের পুঁথি কিংবা দেওয়ান ভাবনার পালাপাঠের আসর বসে। লোকসাহিত্য, লোকনৃত্য, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল মুর্শিদি, মারফতী, কবিগান, যাত্রা, জারী, কীর্তন, পালাগান ইত্যাদি সবই বাংলার লোকসংস্কৃতির অবদান। সমগ্র দেশের লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকলেও ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে অঞ্চল ভেদে এর ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশের সর্বউত্তরে (পঞ্চগড় জেলার পরেই) একটি ছোট্ট জেলা ঠাকুরগাঁও। দিনাজপুর জেলার (বৃহত্তর) অন্তর্গত ঠাকুরগাঁও মহকুমা ১৯৮৪ সালে জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানকার অধিবাসী অধিকাংশই মুসলমান। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু অধিবাসী রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কিছু দেশীয় খ্রিষ্টান এবং আদিবাসী। বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের মধ্যে ঠাকুরগাঁও অঞ্চল অন্যতম। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে প্রাগৈতিহাসিক কালে বাংলাদেশ নামের এই বদ্বীপটি সমুদ্রের তলভূমি ছিল, কালক্রমে তা জেগে উঠে এবং ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। সমুদ্রের তল থেকে সবার আগে জেগে উঠে হিমালয় পর্বত এবং তার পাদদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও তথা দিনাজপুর অঞ্চল। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নেপালের রাজ দরবার থেকে সংগৃহীত বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নির্দশন ‘চর্যাপদ’ এর ভাষার সাথে এ অঞ্চলের ভাষার যথেষ্ট মিল আছে এবং চর্যাপদ যে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে রচিত হয়েছে তার সমর্থন মেলে বাংলাদেশ টেলিভিশন ঠাকুরগাঁও সম্প্রচার কেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। তিনি বলেছেন : ‘‘আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্যরূপের প্রথম প্রকাশও ঘটে ঠাকুরগাঁও এবং এর সন্নিহিত অঞ্চলে। এই ভূমিতেই রচিত হয়েছিল চর্যাপদের কয়েকটি পদ।’’ এমনকি বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন’ যা বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত, তাতেও দেখা যায় গ্রন্থে ব্যবহৃত অনেক শব্দ এই অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। যেমন- বুঢ়া, ঘষি, বেশোয়ার ইত্যাদি। রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদের সন্নিকটে গোরকই নামক স্থানে আবিস্কৃত হয়েছে চর্যাপদের অন্যতম পদকর্তা নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধ সহজীয়া সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু গোরক্ষনাথের মন্দির, তার আমলের পাথরের তৈরি কুয়া ও একটা শিলালিপি। এ শিলালিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গবেষকদের মতে এই গোরক্ষনাথই চর্যাপদের পদকর্তা গোরক্ষনাথ, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এমন অনুমান করলে ভুল হবে না যে, গোরক্ষনাথ এ অঞ্চলে এসেছিলেন বা এ অঞ্চলের তার অনুসারীদের সাথে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। কাজেই এই সিদ্ধান্তে আশা যায়, ঠাকুরগাঁও জেলাসহ এই উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতি অতি প্রাচীন এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
ঠাকুরগাঁওয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন এক সময় উৎসব মুখর ছিল। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। গ্রামে গ্রামে পালা গান, কবিয়াল গান, যাত্রা, ভাওয়াইয়া, বাউল ও ধামের গানের জমজমাট আসর বসত। গ্রাম-গঞ্জে আয়োজিত মেলাগুলোতে সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালাসহ নানারকম জিনিসপত্রের পসার বসত। গ্রামীণ লোকাচার, লোকনাট্য ও লোকগীতির বহুমাত্রিক নান্দনিক রূপায়ণ চিরায়িত গ্রাম বাংলার নিরেট সংস্কৃতির মৃন্ময় প্রকাশ গ্রামের মানুষকে নির্জলা আনন্দ দিত। সাংস্কৃতিক চর্চার এ সুবাতাসকে ঠাকুরগাঁওবাসী বেশি দিন বহমান রাখতে পারেনি। ঠাকুরগাঁয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন এখন অনেকটা স্পন্দনহীন নিষ্প্রাণ অচলায়তনে পরিণত হয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য এলাকার মত আকাশ সংস্কৃতির অশুভ প্রভাব এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্পর্শ করলেও তেমন একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। সম্প্রতি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের মানসে এলাকার সংস্কৃতিমনস্ক মানুষগুলো পুরোনো ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে। শাপলা নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে সম্প্রতি সমাপ্ত হলো সপ্তাহ ব্যাপী নাট্যোৎসব, প্রতি বছর স্বত:স্ফূর্তভাবে আনন্দমুখর পরিবেশে ১লা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়, গ্রামে-গঞ্জে আয়োজন করা হয় মেলার। ধামের গান, বাউল ও আধ্যাত্বিক গানের আসর বসে গ্রামে গ্রামে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস