কালের গহবরে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন মানুষের সংস্কৃতির নিদর্শন হলো পুরাকীর্তি। বিভিন্ন জনপদে বিস্মৃত মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে কিছু স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায়। এই মানুষগুলোর স্মৃতিচিহ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্মৃতিচিহ্নগুলো বিশেষ সময়ে বিশেষ ভূখন্ডে বসবাসকারী মানুষের চিন্তা চেতনাকে উন্মোচিত করে। তাদের প্রযুক্তি, কর্মপদ্ধতি, বাসস্থানের ধরন, ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রীর উপকরণ ইত্যাদিকে জানার সুযোগ করে দেয়। বোঝা যায় তাদের জীবনের গতি প্রকৃতি। যুগে যুগে নানা পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ধরনের শাসন আমলে মানুষ যে পরিবেশে বাস করত কালের প্রবাহে তার বিবর্তন ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বহু স্থানের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণেও গড়ে উঠে নতুন জনপদ কিংবা বিলুপ্ত হয় লোকালয়। আর এসবের পরিচয় বহন করে প্রত্ননিদর্শনসমূহ। বর্তমানের মানুষকে প্রত্ননিদর্শনগুলো নিয়ে যায় ইতিহাসের কাছে। এজন্য প্রত্ননিদর্শন হলো 'ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়'।
বরেন্দ্র অঞ্চলের উত্তরে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও জেলা। পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র উপকূল কিংবা মরুপ্রান্তর কোনোটাই এখানে নেই। এই জেলার বুক জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। সমতল ভূমির উপর দিয়ে এককালে প্রবাহিত ছিল বেশকিছু নদী, যার বেশির ভাগ আজ বিলুপ্ত অথবা ক্ষীণকায়। ছিল বিল, জলাশয়, সবুজ মোহনীয় বন-জঙ্গল। এর মাঝেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে মানুষের বসতি। ঠাকুরগাঁও জেলার সমতল ভূমি, নদী আর প্রকৃতি জনপদ সৃষ্টি এবং সমৃদ্ধির সমান উপযোগী। তাই এই জেলায় পাওয়া যায় যুগে যুগে গড়ে উঠা মানুষের বসতির বিচিত্র ইতিহাস, আর প্রাচীন কীর্তিসমূহ। প্রত্ননিদর্শনগুলো ঠাকুরগাঁও জেলার গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
বাংলাদেশের মাটি নমনীয়, পাথরের প্রাচুর্যতা এখানে কখনই ছিল না। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতো পোড়া মাটির তৈরি ইট দিয়ে। ঠাকুরগাঁও জেলার প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীও এর ব্যতিক্রম নয়। পোড়ামাটির ইটের তৈরি স্থাপত্য পাথরের মত কালজয়ী হতে পারেনি। তাই জেলার অতি প্রাচীন কীর্তিগুলো আজ ধুলায় মিশে গেছে। শুধু ইটের টুকরো, দূরদেশ থেকে নিয়ে আসা কিছু পাথর, বসতির ঢিবি, পোড়ামাটির কোনো ফলক সুদূর অতীতের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্য রাজভিটা, মহালবাড়ি মসজিদ, বাংলাগড়, গড় ভাতুরিয়া, গড়খাঁড়ি, গড়গ্রাম দুর্গ, গোরক্ষনাথ মন্দির, মালদুয়ার দুর্গ, কোরমখাঁন গড়, নেকমরদের ইতিহাস ঠাকুরগাঁও জনপদের অতিক্রান্ত কালের উজ্জ্বল স্মরণিকা।
রাজভিটা
পীরগঞ্জ উপজেলার জাবরহাট ইউনিয়নের হাটপাড়া নামক স্থানে টাঙ্গন নদীর বাঁকে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে যে রাজবাড়ির অস্তিত্ব অনুভব করা যায় তা রাজভিটা নামে বর্তমান মানুষের নিকট পরিচিত। এর সঠিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন। তবে অনুমান করা হয় এটি শেরশাহের সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এখানে শেরশাহ আমলের মুদ্রা পাওয়া যায়। একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে যার বর্ণগুলো অপরিচিত এবং শিলালিপিতে একটি উট, একটি ঘোড়া ও একটি শুকরের প্রতিকৃতি আছে। সাংবাদিক কাজী নুরল ইসলাম তাঁর 'পীরগঞ্জের ঐতিহাসিক রাজভিটা' নিবন্ধে এ সমস্ত তথ্য প্রদান করে বলেছেন-'এগুলোর সূত্র বিশ্লেষণ করা হলে ঐ স্থানে কোন আমলে কোন রাজার রাজভিটা ছিল এর সঠিক তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।'
রাজভিটায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ নেই- সবই মাটির গর্ভে। মাটি খুড়লেই ইট পাথর বের হয়ে আসে। বিভিন্ন ভবনের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। আর নদীর ভাঙনেও নানা আকৃতির প্রচুর ইট ও পাথর বেরিয়ে আসে। নদীর উপত্যকায় পড়ে আছে বহু পাথর ও প্রাচীন ইট। রাজ পরিবারবর্গ টাঙ্গন নদীকেই নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করত যা সহজে বোঝা যায়। রাজভিটা প্রায় ৫০০ মিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ। রাজভিটা থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে শেরশাহ আমলের পূর্ণিয়া সড়কের নিদর্শন আছে।
রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি
রানীশংকৈল উপজেলার পূর্বপ্রান্তে কুলিক নদীর তীরে মালদুয়ার জমিদার রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি। টংকনাথের পিতার নাম বুদ্ধিনাথ চৌধুরী। তিনি ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ এবং কাতিহারে ঘোষ বা গোয়ালা বংশীয় জমিদারের শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত। নিঃসন্তান বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার কাশীবাসে যাওয়ার সময় সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং তাম্রপাতে দলিল করে যান যে তিনি কাশী থেকে ফিরে না এলে শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত এই জমিদারির মালিক হবেন। পরে বৃদ্ধ জমিদার ফিরে না আসার কারণে বুদ্ধিনাথ চৌধুরী জমিদারি পেয়ে যান। তবে অনেকে মনে করেন এই ঘটনা বুদ্ধিনাথের দু এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে।
রাজবাড়ি নির্মাণের কাজ বুদ্ধিনাথ চৌধুরী শুরু করলেও সমাপ্ত করেন রাজা টঙ্কনাথ। বৃটিশ সরকারের কাছে টঙ্কনাথ রাজা পদবী পান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। বর্তমানে রাজবাড়িটির অনেক অংশই নষ্ট হয়ে গেছে। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে সিংহদরজা। দরজার চূড়ায় দিক নির্দেশক হিসেবে লৌহদন্ডে S.N.E.Wচিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। রাজবাড়ি সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারিবাড়ি। পূর্বদিকে দুটি পুকুর। রাজবাড়ি থেকে প্রায় দু'শ মিটার দক্ষিণে কুলিক নদীর তীরে রাস্তার পূর্বপ্রান্তে রামচন্দ্র (জয়কালী) মন্দির। এই মন্দিরটি রাজবাড়ির চেয়ে প্রাচীন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনারা মন্দিরটির ক্ষতি সাধন করে। এখন এটা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
হরিপুর রাজবাড়ি
হরিপুর উপজেলার কেন্দ্রস্থলে হরিপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ি ঘনশ্যাম কুন্ডুর বংশধরদের দ্বারা প্রতি''ষ্ঠত। মুসলিম শাসন আমলে আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম কুন্ডু নামক একজন ব্যবসায়ী এন্ডি কাপড়ের ব্যবসা করতে হরিপুরে আসেন। তখন মেহেরুন্নেসা নামে এক বিধবা মুসলিম মহিলা এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তাঁর বাড়ি মেদিনীসাগর গ্রামে। জমিদারির খাজনা দিতে হতো তাজপুর পরগনার ফৌজদারের নিকট। খাজনা অনাদায়ের কারণে মেহেরুন্নেসার জমিদারির কিছু অংশ নিলাম হয়ে গেলে ঘনশ্যাম কুন্ডু কিনে নেন।
ঘনশ্যামের পরবর্তী বংশধরদের একজন রাঘবেন্দ্র রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৃটিশ আমলে হরিপুর রাজবাড়ির কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর সময়ে রাজবাড়ির কাজ শেষ হয়নি। রাঘবেন্দ্র রায়ের পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজবাড়ির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। এসময় তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক রাজর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। জগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সমাপ্তকৃত রাজবাড়ির দ্বিতল ভবনে লতাপাতার নকশা এবং পূর্ব দেয়ালের শীর্ষে রাজর্ষি জগেন্দ্র নারায়ণের চৌদ্দটি আবক্ষ মূর্তি আছে। তাছাড়া ভবনটির পূর্বপাশে একটি শিব মন্দির এবং মন্দিরের সামনে নাট মন্দির রয়েছে। রাজবাড়িতে ছিল একটি বড় পাঠাগার যার অস্তিত্ব এখন নেই। রাজবাড়িটির যে সিংহদরজা ছিল তাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ১৯০০ সালের দিকে ঘনশ্যামের বংশধররা বিভক্ত হলে হরিপুর রাজবাড়িও দু'টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। রাঘবেন্দ্র-জগেন্দ্র নারায়ণ রায় কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়িটি বড় তরফের রাজবাড়ি নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে নগেন্দ্র বিহারী রায় চৌঃ ও গিরিজা বল্লভ রায় চৌঃ ১৯০৩ সালে আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম ছোট তরফ।
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে জগদল নামক স্থানে নাগর ও তীরনই নদীর মিলনস্থলে ছোট একটি রাজবাড়ি রয়েছে। রাজবাড়িটির সম্ভাব্য নির্মাণকাল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। বর্তমানে রাজবাড়িটি প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়ি থেকে প্রায় একশ মিটার পশ্চিমে নাগর নদীর পাড়ে মন্দির ছিল যা আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। জগদলের রাজকুমার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্র কুমার। তাঁর সঙ্গে বাকীপুরের জমিদার রায় পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের পুত্র শ্রী নলিনী রঞ্জনের কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতি আশালতা দেবীর বিয়ে হয়। শ্রী বীরেন্দ্র কুমার সুশিক্ষিত ছিলেন। বইয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। এ কারণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ পাঠাগার । তৎকালীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ - বর্তমান দিনাজপুর সরকারি কলেজে ১৯৪৮ সালে তাঁর পাঠাগারের বইগুলো দান করা হয়, যার মূল্যমান ধরা হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা।
প্রাচীন রাজধানীর চিহ্ন নেকমরদ
রানীশংকৈল উপজেলার ভবানন্দপুর - আজকের নেকমরদে ছিল খরস্রোতা কাইচা নদী। নদীর তীরে গড়ে উঠে জনপদ। এই জনপদের সভ্যতা কতখানি প্রাচীন তা নির্ণয় করা দুষ্কর। খরস্রোতা কাইচা নদীও আজ বিলুপ্ত প্রায়। নেকমরদ ও তার নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে মাটির নিচে পাওয়া যায় প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন। দুর্গ,দিঘি,মন্দির-মন্ডপ,পাথর-ব্রোঞ্জের মূর্তিসহ অসংখ্য ছোটবড় পাথরের নিদর্শন প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদের স্মৃতিই বহন করছে।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর 'বৃহৎ বঙ্গ' গ্রন্থে 'করবর্তন রাজী' বা কর্মবাটন' নামক প্রাচীন উত্তরবঙ্গের একটি স্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকের ধারণা 'করবর্তন রাজী' বা করবর্তন রাজ্যের রাজধানী ছিল নেকমরদেই। নেকমরদের মাজারকে কেন্দ্র করে প্রায় বিশ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এবং মাজারের দেড় কিলোমিটার উত্তরে গড়গ্রামের প্রাচীন দুর্গ রাজধানীর ধারণাটিকে সমর্থন করে। নীহারঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস ( আদি পর্ব )' গ্রন্থেও করবত্তন বা করপত্তন বা করমবত্তন নামক একটি জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে প্রতিদিন সকাল বেলা ১৫০০ টাঙ্গন (টাট্টু) ঘোড়া বিক্রয় হতো। তিনি বলেছেন কেউ কেউ মনে করেন এটি দিনাজপুর জেলার অর্থাৎ বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জেলার নেকমরদ হাট । এখান থেকেই লক্ষণাবতীর ঘোড়া কেনা হতো।
প্রত্ন উপকরণ হিসেবে ১৯৬৭ সালে নেকমরদ আলিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকালে দশটি প্রাচীন ব্রোঞ্জ মূর্তি পাওয়া যায়। এগুলো পাল বা সেন যুগের হতে পারে। সম্ভবত মোহাম্মদ বখতিয়ারের লখ্নৌতি বঙ্গ বিজয়ের সময় নেকমরদ এলাকাটি মুসলমানদের অধিকারে আসে। তখন হিন্দুরা এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কালে পাথর ও ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলো মাটির নিচে ও পুকুরে ফেলে যায়। পীর শাহ নেকমরদের মাজারের উত্তরপাশে একটি প্রাচীন পুকুর আছে। পুকুরটির ঘাটে দুটি বেলে পাথর রয়েছে। তার একটিতে নৃত্যরতা রমণীমূর্তি উৎকীর্ণ। পাথরের নির্মিত বৃষের ভাঙা মূর্তির অংশও দেখা যায় সেখানে। শোনা যায় কোনো এক সময় পুকুরটি সংস্কার করতে গিয়ে প্রসত্মরের তৈরি অনেকগুলো মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। পুকুরটির পূর্ব পাড়ে ৮র্×৩র্×৫র্ আয়তনের একটি গ্রানাইট পাথর পড়ে আছে। এ ধরনের বহু গ্রানাইট পাথর নেকমরদের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে। পাল-সেন যুগে কালো পাথরের ব্যবহার বেশি হতো এবং গুপ্ত যুগে গ্রানাইট ও বেলে পাথরের প্রচলন বেশি ছিল। তাই ধারণা করা হয় গুপ্ত যুগেই নেকমরদে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল।
পীর শাহ নেকমরদের মাজার
রানীশংকৈল উপজেলা থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার উত্তরে নেকমরদ স্থানটি। এলাকাটির মূল নাম হচ্ছে ভবানন্দপুর। আজও নেকমরদকে মৌজা হিসেবে ভবানন্দপুর লেখা হয়। শেখ নাসির-উদ-দীন নামক এক পূণ্যবান ব্যক্তি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভবানন্দপুর আসেন। তিনিই পীর শাহ নেকমরদ নামে খ্যাতিমান এবং এই খ্যাতিমান পুণ্যাত্মা পুরুষের কারণেই ভবানন্দপুর পরবর্তীকালে নেকমরদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
নেকমরদ বাজারের পূর্বদিকে পীর শেখ নাসির-উদ-দীন নেকমরদের মাজার। তাঁর সম্পর্কে জনশ্রুতি ছাড়া সঠিক ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা হয় সুলতানি আমলে তাঁর আগমন ঘটে। পীর শাহ নেকমরদ সম্পর্কে আছে নানাধরনের চমকপ্রদ কিংবদন্তী। নেকমরদ এলাকাটি প্রত্ন উপকরণে সমৃদ্ধ। পীর শাহ নেকমরদের মাজার প্রত্ন উপকরণের মাঝে প্রতিষ্ঠিত বলে কিংবদন্তীর কাহিনী আরো জোড়ালো। যেমন হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগে ভীমরাজ ও পীতরাজ নামে দুভাই এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তাদের শাসনামলে প্রজা সাধারণ ছিল নির্যাতিত। অনাচার, দুর্নীতি আর অরাজকতায় মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। এমন দুঃসময়ে শেখ নাসির-উদ-দীন নেকমরদ এই রাজ্যে প্রবেশ করেন। ভীমরাজ ও পীতরাজ কৌশলে তাঁকে বাধা দিলে তিনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে সেই বাধা ছিন্ন করেন। বিরক্ত হয়ে অত্যাচারী দুভাইকে অভিশাপ দিলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয় পীর শাহ নেকমরদের আস্তানা। বিধ্বস্ত রাজধানীর উপর শুরু হয় নতুন জনপদের যাত্রা। পীর শাহ নেকমরদ পহেলা বৈশাখে ইন্তেকাল করেন। তাঁর পূণ্য স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে এই তারিখে পবিত্র ওরস উদযাপন ও বার্ষিক মেলার প্রবর্তন হয়। এই মেলাই হচ্ছে বিখ্যাত নেকমরদ মেলা। পীর শাহ নেকমরদের মাজার সম্পূর্ণ কাঁচা ছিল। মাজারের কারুকার্য খচিত চাঁদোয়া এবং জামে মসজিদটি প্রায় আশি বছর পূর্বে নির্মিত হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা হতে উত্তরে মীরডাঙ্গী থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে মহেশপুর গ্রামে মহালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহের আমলে এটি প্রতিষ্ঠিত। দিনাজপুর জাদুঘরে শিলালিপিটি সংরক্ষিত ছিল। শিলালিপি সূত্রে জানা যায় মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মিয়া মালিক ইবনে জুযমদার। এটি ছিল তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদে ভূমি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু চারদিকে শিলা প্রাচীর ছিল। যে শিলাগুলো থাম হিসেবে ব্যবহৃত সেগুলো নকশা করা। শিলা-প্রাচীরের উপরে নির্মিত হয় ইটের দেয়াল। ছাদেও শিলাখন্ডের ব্যবহার ছিল। ছাদ থেকে পানি বের করে দেয়ার জন্য খোদিত শিলার ব্যবহার দেখা যায়। ১৯৭১ সালের পূর্বেই মূল মসজিদটি ধ্বংস হয় এবং সেখানে নির্মিত হয় নতুন মসজিদ। নবনির্মিত মসজিদটির ভিত ও মেঝেতে প্রাচীন মসজিদের পাথর এবং দেয়ালে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মসজিদের কাছে নকশা করা ও নকশাবিহীন বেশকিছু শিলাখন্ড পড়ে রয়েছে। প্রাচীন মসজিদের নকশা করা প্রায় ৩৬ ×৩০ ইঞ্চি আয়তনের শিলাখন্ড নতুন মসজিদের মিহরাবে আটকানো আছে। এছাড়া প্রাচীন মসজিদের তিন তাকের নকশা করা শিলাখন্ডের মিম্বারটি এখনো নতুন মসজিদের সামনে পড়ে রয়েছে।
মসজিদের পূর্বপাশে আছে একটি ছোট দিঘি। দিঘিটির উত্তর পাড়ের ঘাট উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পাথরে বাঁধানো। মসজিদের দুশ মিটার পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে দুটি কবর। কবর দুটি একসঙ্গে ইট দিয়ে বাঁধানো। কবরের উত্তর-পশ্চিমের কোণে নকশা করা একটি পাথরের থাম রয়েছে। হয়তো কবরের চারকোণেই এ ধরনের থাম ছিল। কবর দুটির মধ্যে একটি 'বিশ্বাস পীরের' মাজার বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত। সম্ভবত বিশ্বাস শব্দটি ক্রমান্বয়ে বিশওয়াশ থেকে বিশ বাইশ শব্দে বিকৃত হয়েছে। ফলে এলাকাটিকে বলা হয় বিশবাইশ মহাল।
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জহাট। হাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ। মসজিদ অঙ্গনে প্রবেশমুখে বেশ বড় সুন্দর একটি তোরণ রয়েছে। তাজপুর পরগনার জমিদারবাড়ি থেকে রওশন আলী নামক এক ব্যক্তি এ অঞ্চলে আসেন। তাঁরই বংশধররা পরবর্তীতে এখানে জমিদারী পান। ১৮৬২ সালে জমিদারবাড়ির ভিত্তি স্থাপন করা হয়। বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৮৬৭ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফলে মসজিদের ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও জমিদার বাড়িটির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়।
মসজিদটির শিল্পকলা দৃষ্টিনন্দিত, মনোমুগ্ধকর ও প্রশংসাযোগ্য। মসজিদে বড় আকৃতির তিনটি গম্বুজ আছে। গম্বুজের শীর্ষদেশ কাচ পাথরের কাজ করা। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মিনারগুলো। মসজিদের ছাদে আটাশটি মিনার আছে। একেকটি মিনার ৩৫ ফুট উঁচু এবং প্রতিটিতে নকশা করা রয়েছে। গম্বুজ ও মিনারের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য। এত মিনার সচরাচর কোন মসজিদে দেখা যায় না। মসজিদটির চারটি অংশ হলো মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদসহ বারান্দা, ছাদবিহীন বারান্দা এবং ছাদবিহীন বারান্দাটি অর্ধ প্রাচীরে বেষ্টিত হয়ে পূর্বাংশে মাঝখানে চার থামের উপর ছাদ বিশিষ্ট মূল দরজা। খোলা বারান্দার প্রাচীরে এবং মূল দরজার ছাদে ছোট ছোট মিনারের অলংকার রয়েছে। মূল কক্ষের বাইরের দিক থেকে পরিমাপ হচ্ছে ২৯×৪৭ ফুট এবং ছাদবিহীন বারান্দার পরিমাপ ২১×৪৭ ফুট। মূল কক্ষের কোণগুলো তিন থাম বিশিষ্ট। এর জানালা দুটি, দরজা তিনটি, কুলুঙ্গি দুটি। মসজিদটির ভিতরে দরজায়, বারান্দায় এবং বাইরের দেয়ালগুলোতে প্রচুর লতাপাতা ও ফুলের সুদৃশ্য নকশা রয়েছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের হংসরাজ এবং তার পুত্র রামহিৎ মসজিদটির মূল কারিগর। দ্বারভাঙ্গা এলাকার কারিগরেরাও নির্মাণ কাজে অংশ নেয়।
শালবাড়ি মসজিদ ও ইমামবাড়া
ঠাকুরগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ভাউলারহাটের নিকটে শালবনে শালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি বাংলা ১২১৫ সালে তৈরি হয়েছে। সংস্কারের কারণে মসজিদটির মূল নকশা নষ্ট হয়ে গেছে। শালবাড়ি মসজিদটির অদূরে ভগ্নদশার একটি ইমামবাড়া আছে। এটাও মসজিদটির সমসাময়িক বলে অনুমান করা হয়। ইমামবাড়াটির পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে দুটি করে চারটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দুটি দরজা আছে। এর বাইরের পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ঊনিশ ফুট ছয় ইঞ্চি এবং প্রস্থে তের ফুট। এখানে মহরমের অনুষ্ঠানাদি হতো।
সনগাঁ শাহী মসজিদ
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কালমেঘ হাট থেকে দু কিলোমিটার উত্তরে সনগাঁ নামক গ্রামে সনগাঁ মসজিদটি নির্মিত। মোঘল সম্রাট শাহ আলমের সময় এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মসজিদে তিনটি গম্বুজ ও তিনটি দরজা আছে। দক্ষিণে একটি পাকা কূপ আছে। কূপের গায়ে পোড়ামাটির বাংলালিপি রয়েছে। তবে লিপিটি অস্পষ্ট হওয়ায় পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মসজিদের পূর্বপাশে প্রাচীন কবর আছে। এখানেই শুয়ে রয়েছেন 'সুধিবাদ পীর' নামক এক পূণ্যাত্মা।
ফতেহ্পুর মসজিদ
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে মোড়লহাটের সন্নিকটে ফতেহ্পুর মসজিদ। এটি মোঘল আমলে নির্মিত। মসজিদে তিনটি গম্বুজ আছে। চারকোণে চারটি অর্ধ নিমগ্ন কৌণিক থাম রয়েছে যার নিচের অংশে ঘড়ার নকশা আছে। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিমের দেয়ালে আছে দুটি করে চারটি থাম। মসজিদটিতে ছয় ফুট উচ্চতার একটি দরজা আছে। কিন্তু মসজিদটিতে গভীর কোনো মিহরাব নেই তবে মিহরাবের ফ্রেম রয়েছে। এর বাইরের আয়তন দৈর্ঘ্যে ত্রিশ ফুট ছয় ইঞ্চি এবং প্রস্থে তের ফুট ছয় ইঞ্চি। ভিতরের প্রশস্ততা এক কাতারে নামাজ পড়ার মত।
মেদিনীসাগর জামে মসজিদ
হরিপুর উপজেলার উত্তরে মেদিনীসাগর গ্রামে মেদিনীসাগর জামে মসজিদটি অবস্থিত। স্থাপত্যকাল মোঘল আমল । বাইরের দিক থেকে মসজিদের দৈর্ঘ্য সাড়ে একত্রিশ ফুট এবং প্রস্থ চৌদ্দ ফুট। ভিতরের দৈর্ঘ্য চবিবশ ফুট এবং প্রস্থ ছয় ফুট। এক কাতারে নামাজ পড়া যায়। মিহরাব ও মিম্বার আছে। দুটি জানালা, তিনটি দরজা, আটটি কুলুঙ্গি, তিনটি খিলান রয়েছে। মসজিদের চার কোণে চারটি কৌণিক থামের নিচে ঘড়া আছে। এছাড়া মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে দুটি করে চারটি থাম রয়েছে। এই মসজিদের সঙ্গে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফতেহ্পুর মসজিদের স্থাপত্য মিল রয়েছে।
গেদুড়া মসজিদ
হরিপুর উপজেলার গেদুড়া ইউনিয়নে গেদুড়া মসজিদটি প্রায় আড়াইশ বছর পূর্বে স্থাপিত হয়। বর্তমানে পুরাতন মসজিদটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। একইস্থানে নতুন মসজিদ তৈরি হয়েছে। এখানে আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত গোলাকার একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলালিপিটির পরিধি ৫৪ বর্গ ইঞ্চি।
গোরক্ষনাথ মন্দির, কূপ ও শিলালিপি
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে গোরকুই নামের একটি গ্রাম। নাথগুরু গোরক্ষনাথের সাথে গ্রামের নামটি স্মৃতি বিজড়িত। এই গ্রামে নাথ আশ্রমে পাঁচটি মন্দির ও একটি ব্যতিক্রমধর্মী অতি প্রাচীন কূপ রয়েছে। গোরক্ষনাথ নামের সাথে কূপটির নাম যুক্ত হয়ে গোরক্ষকূপ থেকে গোরকুই নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। গোরক্ষনাথের মহিমা প্রচারে নাথ সাহিত্যের কারণে বাংলা সাহিত্যে গোরক্ষনাথ নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোরক্ষনাথের সময় নির্ধারণ করতে গিয়ে ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ 'গ্রন্থে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-'অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে যে-কোন সময়ে তিনি মর্ত্যদেহ ধারণ করে বর্তমান ছিলেন, এমন কথা শোনা যায়'। তাঁর আবির্ভাবের স্থান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কল্পকাহিনীর প্রচার আছে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে গোরক্ষনাথ পেশোয়ারে আবির্ভূত হন। গোরক্ষপন্থীদের মতে তিনি পাঞ্জাবের অধিবাসী কিন্তু পরে বিহারে বসবাস করেন। সম্ভবত সন্ন্যাসীদের মতো অনেক জায়গা তিনি ভ্রমণ করেছেন। একটি প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। জনশ্রুতিটি হলো-গোরক্ষনাথ এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে ফকিরদের আগমনের কথা মায়া শক্তিতে জানতে পেরে উৎকণ্ঠিত হন। তাই তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে পশ্চিমদিক থেকে আসছিলেন। পথিমধ্যে খরস্রোতা নোনা নদী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ বাধা তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। তিনি খড়ম পায়ে পানির উপর হাঁটতে শুরু করেন। পূর্বে কাইচা নদীর তীরে অবস্থান করছিলেন পীর শাহ নেকমরদ। অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি দেখতে পান গোরক্ষনাথের কেরামতি। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন পীর শাহ নেকমরদ। আর এতেই অঘটন ঘটলো। গোরক্ষনাথ নদীতে তলিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর পরনের গামছা ভিজে গেল। ধ্যানের মাধ্যমে ঘটনা জানতে পেরে গোরক্ষনাথ আর অগ্রসর হলেন না। সেখানে বালুচর সৃষ্টি করে তিনি বসে পড়েন। বালুচরে নাথ আশ্রম গড়ে উঠে। কিন্তু এটা শুধুই কাহিনী। কারণ পীর শাহ নেকমরদ গোরক্ষনাথের সমসাময়িক নন। তিনি গোরক্ষনাথের অনেক পরে। তবে গোরক্ষনাথ এই অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন না, তিনি যে ভ্রমণকারী সিদ্ধপুরুষ সন্ন্যাসী ছিলেন এই ধারণাকে কাহিনীটি সমর্থন করে।
গোরকুই নাথ আশ্রমের মন্দির পাঁচটি কয়েক দফা সংস্কার করা হয়েছে। সম্ভবত পুরাতন মন্দিরের উপর সর্বশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্তমান মন্দিরগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হয়। ইটের প্রাচীর বেষ্টিত আশ্রমটির উত্তরদিকে দক্ষিণমুখী দরজার একটি, পূর্বদিকে পশ্চিমমুখী দরজার তিনটি এবং কূপের প্রাচীর সংলগ্ন দক্ষিণমুখী দরজার একটি মন্দির রয়েছে। পূর্বদিকের তিনটি মন্দিরের মধ্যে মাঝখানেরটি তুলনামূলকভাবে পাশের দুটির চেয়ে উচ্চতায় বড়। জানা যায় এই মন্দিরটির পূর্ব দেয়ালে কালো পাথরের নরমুন্ড বেষ্টিত খুব ছোট কালীমূর্তি আটকানো ছিল। মন্দিরের সেবায়েত জানান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ১২/১৩ বছর পর কে বা কারা এই কালীমূর্তিটি নিয়ে যায়, যার সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। কালীমন্দিরটির ছাদ অনেকটা দোচালা ঘরের মত। এর দু'পাশের মন্দির দুটিকে বলা হচ্ছে শিব মন্দির এবং উভয় মন্দিরে একটি করে গম্বুজ রয়েছে। উত্তরের মন্দিরটিও শিব মন্দির। 'বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস' গ্রন্থে প্রত্নতাত্তিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া কূপ সংলগ্ন মন্দিরটিকে বলেছেন 'সমাধি মন্দির'। অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে মনে করেন এটিই নাথ মন্দির। মন্দিরটি চারচালা বিশিষ্ট। এর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে পরিমাপ হলো সাড়ে এগার ফুট ও এগার ফুট।
নাথ মন্দিরের সাথেই উত্তরপাশে গোরকুই কূপ। কূপটি সম্পূর্ণ বেলে পাথরে নির্মিত। বাংলাদেশের কোথাও পাথরের নির্মিত এধরনের কূপের সন্ধান পাওয়া যায় না। কূপটির চারদিকে ইটের প্রাচীর। তবে পূর্ব ও পশ্চিমদিকে একটি করে দরজা আছে। মূল ভূমি থেকে প্রায় তিন ফুট নিচুতে কূপের মেঝে। মেঝেটি বেলে পাথরে নির্মিত। মূল ভূমি থেকে মেঝেতে নামার জন্য সিঁড়িগুলোও বেলে পাথরের। কূপটির গভীরতা সাড়ে সাত ফুট এবং এর ব্যস আড়াই ফুট। বেলে পাথর সামান্য বাঁকানোভাবে কেটে কূপের মুখ থেকে তলদেশ পযন্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বসানো হয়েছে। কূপের তলটুকুতেও মাটি নেই। একটি পাথরের সাথে আরেকটি পাথরের জোড়া লাগাতে কোনো মসলা ব্যবহার করা হয়নি। মনে করা হয় পাথরের জোড়াগুলো দিয়ে কূপটি পানিতে ভর্তি হতো। আবার এরূপ কথাও প্রচলিত রয়েছে যে কূপের তলদেশে পাথরের মাঝখানে দুটি ছিদ্র ছিল। সেই ছিদ্র দুটি বন্ধ করে দিলে কূপের ভিতরে পানি আসত না এবং খুলে দিলে পানিতে পূর্ণ হতো। এখানকার নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কূপের পানিকে পবিত্র মনে করে। ফালগুন মাসে প্রতি বছর এখানে মেলা বসে। মানুষের বিশ্বাস মেলার তিথিতে এই কূপের পানি দিয়ে গোসল করলে রোগমুক্তি ঘটে।
কূপের উত্তরে একটি টিনের চারচালা ঘরের দরজার নিচের চৌকাঠ হিসেবে ব্যবহৃত দুটি বেলে পাথরে উৎকীর্ণ শিলালিপি পাওয়া যায়। এগুলোর প্রথম সন্ধান পান প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। শিলালিপির পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন-প্রথম পাথরে খোদিত লিপিতে ১০ পঙক্তির নিচে একটি রেখা টানা। রেখার নিচে আছে একটি অশ্বমূর্তি ও একটি বরাহের মসত্মকদেশ। সংলগ্ন দ্বিতীয় পাথরে ছিল বরাহের দেহের অবশিষ্টাংশ ও একটি বৃষমূর্তি। অমসৃণ ও নিকৃষ্টমানের বেলে পাথরে খোদিত লিপিটি ক্ষয়প্রাপ্ত ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পঙক্তির 'খরগাম', নবম পঙক্তির 'রমনসক' ও দশম পঙক্তির '৯২০ তারিখ( বা তারখ) ১৭ মাঘ' এই ক'টি শব্দ ছাড়া এই দুর্বোধ্য ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলালিপির আর কোনো পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত আলোচ্য শিলালিপিটি গোরকুই কূপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। জনাব যাকারিয়া বলেন-নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে গোরক্ষনাথের আবির্ভাব বলে ধরা হয়। কূপটি যদি গোরক্ষনাথের সমাধির সাথে সম্পৃক্ত হয় তবে এটি পাল-সেনযুগে নির্মিত হয়েছিল। আরবি তারিখ শব্দের উপস্থিতি ও লিপির রূপ দেখে নিঃসন্দেহে ধরা যায় যে, এটি মুসলিম আমলে খুব সম্ভব সুলতানি আমলের শেষদিকে লিপিকৃত হয়েছে। প্রাচীন মন্দির ধ্বংস হয়ে গেলে সুলতানি আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের উপরেই নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। আলোচিত শিলালিপিটি সম্ভবত মন্দির নির্মাণের সময় সংযুক্ত করা হয়েছিল।
হরিণমারী শিব মন্দির
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে উত্তর পশ্চিমদিকে হরিণমারী হাটের উপর শিবমন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরের ছাদ চারচালা পদ্ধতিতে নির্মিত। এটা বেশ খানিকটা বসে গেছে। মন্দিরটির বর্তমান উচ্চতা প্রায় ত্রিশ ফুট এবং আয়তন ১৪ ×১৪ ফুট। দক্ষিণ দিকে একটি দরজা আছে। দরজায় পোড়ামাটির ফলকে লতাপাতার নকশার সাথে বিভিন্ন মূর্তির প্রতিকৃতি ছিল। বর্তমানে সেগুলো ভেঙ্গে গেছে। মন্দিরের পূর্বদিকে বেশ বড় একটি পুকুর আছে। আনুমানিক চারশ বছরের পুরাতন হতে পারে মন্দিরটি।
হরিপুর রাজবাড়ি শিব মন্দির
ছোট তরফের রাজবাড়ির সামনে একটি শিব মন্দির আছে। এর ছাদ অনেকটা ছাতা আকৃতির আটচালা বিশিষ্ট এবং দেয়ালগুলো অনুরূপ আট কোণ বিশিষ্ট। মন্দিরের চারদিকে বিভিন্ন নকশা ও মূর্তির প্রতিকৃতি ছিল। এর দক্ষিণে একটি দরজা এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে একটি করে ক্ষুদ্রাকৃতির জানালা আছে। মন্দিরটির ছাদ বর্তমানে প্রায় বিধ্বস্ত হওয়ার পথে। এই মন্দিরটি আনুমানিক চারশ বছরের পুরাতন।
গোবিন্দনগর মন্দির
ঠাকুরগাঁও শহরে টাঙ্গন নদীর পশ্চিম তীরে কলেজপাড়ায় গোবিন্দনগর মন্দির অবস্থিত। গোবিন্দনগরের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৭০১ সালে রাজা গোবিন্দ রায়ের মাতা টাঙ্গনের তীরে হরির সন্তুষ্টি সাধনে একটি মন্দিরের আচ্ছাদন তৈরি করেন। বর্তমানে যে মন্দিরটি রয়েছে তার সাথে লাগা পশ্চিমে গড়ে উঠা বস্তিতে এক সময়ে একটি ছোট মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ পাওয়া যায়। এটাই গোবিন্দ মন্দির বলে ধারণা করা হয়। মন্দিরটি রাজা গোবিন্দ রায় বা তার পূর্ব পুরুষ কর্তৃক মোঘল আমলের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরে গোবিন্দজী নামে শ্রী কৃষ্ণের পূজা করা হতো। মন্দির ও রাজবাড়ি গড়ের ভেতরে অবস্থিত। গড়টির চারদিক মাটির প্রাচীর ও গভীর পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। গড়ের পূর্বের সম্পূর্ণ ও দক্ষিণের বেশ খানিকটা প্রাচীর নদী ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের উত্তরপাশের প্রাচীর কেটে সমতল করা হয়েছে। পশ্চিমে জেলা পরিষদ কার্যালয়ের কাছে শহীদ ফাদার লুকাস টেড্র স্কুলটি গড়ের প্রাচীর কেটে তার উপরে স্থাপিত হয়েছে। শুধুমাত্র জেলা পরিষদের দক্ষিণপাশে সাঁওতাল বস্তির কাছে গড়ের প্রাচীরের সামান্য অংশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমানে গোবিন্দ মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা রামনাথ নতুন করে তৈরি করেছিলেন। পরে মন্দিরটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরে যে গোবিন্দজী বিগ্রহের পূজা হতো সে সম্পর্কে একটি গল্পের প্রচলন আছে। বলা হয় শালবাড়ি পরগনার জমিদারের রক্ষক হিসেবে এই মূর্তিটি তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজা রামনাথ মূর্তিটি চুরির উদ্দেশ্যে একজন চতুর ব্রাহ্মণ নিয়োগ করেন এবং চুরির সুবিধার্থে পুনর্ভবার সাথে টাঙ্গন নদীকে যুক্ত করে ১২ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করেন, যার নাম হয় রামদাড়া। ব্রাহ্মণ চৌর্যবৃত্তে সফল হলে রাজা রামনাথের সাথে জমিদারের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জমিদার পরাজিত হলে শালবাড়ি পরগনা রাজা রামনাথের দখলে আসে। গোবিন্দজী'র বিগ্রহ ও রামদাড়া সম্পর্কে মিঃ স্ট্রং রচিত দিনাজপুর জেলার গেজেটিয়ারে পাওয়া যায় - Ramnath conquered and dispossessed the zaminder of Gobindanagar, near the present village of Thakurgaon, employing a Brahmin to steal his protecting deity or family idol Gabinda, and thus causing his downfalll. The conqueror subsequently constructed a canal connecting Gobindanagar on the Tangan with Prannagar near the Punarbhaba for the purpose of taking the idol backwards and forwards between the two places.
ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর সড়কে ঠাকুরগাঁও বিডিআর ক্যাম্প থেকে খোচাবাড়ী-ঊনত্রিশ মাইল পর্যন্ত রাস্তার উত্তরপাশে ক্ষীণকায় যে খালটি আজও দেখা যায়, যার উঁচু ঢিবির উপর বন বিভাগের সেগুন গাছগুলো রয়েছে, সেই খালের নাম রামদাড়া।
ঢোলরহাট মন্দির
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে রুহিয়া যাওয়ার পথে ঢোলরহাট নামক জায়গায় পাকা রাস্তার পশ্চিমপাশে তিনটি মন্দির আছে। মন্দির তিনটির একটি শিব মন্দির, একটি দেবী মন্দির এবং একটি বিষহরি মন্দির নামে পরিচিত। ঢোলরহাট শিব মন্দিরটি দ্বিতল বিশিষ্ট। গম্বুজসহ মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। মন্দিরটির বাইরের দেয়াল ৮ কোণ বিশিষ্ট, কিন্তু ভিতরে কোণ নেই । প্রথম তলার পূর্ব ও দক্ষিণদিকে দুটি দরজা আছে। দক্ষিণ দরজায় সতেরটি শিবলিঙ্গের প্রতিকৃতি ছিল যা অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া দরজার উপরে কুকুরের মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দরজায় শিবলিঙ্গের কোনো প্রতিকৃতি নেই। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার মূর্তি আছে। বাইরের দেয়ালে পলেস্তরার উপরে লতাপাতা ও ফুলের নকশা দেখা যায়। প্রথম তলায় ভিতরে ছাদ গম্বুজের ন্যায় গোলাকৃতি কিন্তু দ্বিতীয় তলার মেঝে সমতল। দ্বিতীয় তলার চারদিকে চারটি ছোট দরজা ও চারটি জানালা আছে। জানালাগুলোতে ত্রিভুজ আকৃতির ইটের জাল বা খোপ রয়েছে। দ্বিতীয় তলার উপরে যে গম্বুজটি ছিল তা ভেঙ্গে গেছে। মন্দিরের ভিতরে বৃহৎ আকৃতির শিব লিঙ্গ আছে এবং এখনো তার পূজা হয়। মন্দিরটির পূর্ব পাশে একটি বড় পুকুর আছে। শিব মন্দির থেকে ৫০ গজ পশ্চিমে বিষহরি মন্দির। এই মন্দিরে মনসা দেবীর পূজা করা হতো। বর্তমানে মন্দিরটির ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। বিষহরি মন্দিরের সঙ্গে লাগা পশ্চিমে দেবী মন্দির। মন্দিরটিতে দেবী দুর্গার পূজা হতো এবং এখনো পূজা হয়। মন্দিরের ছাদ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। শুধু দাঁড়িয়ে আছে চারপাশের দেয়াল । উত্তর দেয়ালে পলেস্তরায় দুর্গার মূর্তি ছিল যা নষ্ট হয়ে গেছে। মূর্তিটির উপরে এবং পাশে পৌরাণিক কাহিনীচিত্র আছে। দুর্গার পায়ের কাছে বেদীতে শুয়ে আছে শিব মূর্তি। তার নিচে বেদীর দেয়ালে ছয়টি মূর্তি অঙ্কিত আছে এবং মূর্তিগুলোর উপরে নারদ, ইন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও নন্দি এই ছয়টি নাম লেখা আছে। মন্দিরটির ভিতরের দিকে উচ্চতায় ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট এবং প্রস্থ ১২ ফুট। মন্দিরের পূর্ব পশ্চিমে দুটি ছোট দরজা এবং দক্ষিণে একটি বড় দরজা রয়েছে। দক্ষিণে ৭.৫ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা ছিল যা এখন সম্পূর্ণ নষ্ট। বারান্দার যে অংশটুকু এখনো দাuঁড়য়ে আছে তাতে নানাধরনের পৌরাণিক মূর্তি আছে।
মন্দির তিনটি সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত। যেমন মন্দির তৈরির জন্য যত লোক নিয়োগ করা হয়েছিল কাজ সেই অনুপাতে দ্রুত গতিতে হতে থাকে। আবার কখনো নিয়োগকৃত শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমিককে মন্দিরের কাজ করতে দেখা যেত। তাই লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বব্রহ্মা নিজ হাতে মন্দির নির্মাণ করেন। অন্য একটি কাহিনী হলো অতীতে এখানে নরবলি দেয়া হতো। তবে মন্দিরে বর্তমান সেবায়েত এই কাহিনী নাকচ করে দিয়ে বলেন-মন্দিরের পার্শ্ববর্তী গ্রামে এক বিধবা মহিলা ছিল। সম্ভবত চরিত্র নষ্টের আশংকায় বিধবা মহিলাটিকে দুর্গার সন্তুষ্টির জন্য দেবী মন্দিরে পূজার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা হয়। দুর্গা সন্তুষ্ট চিত্তে বিধবাটিকে পূজা হিসেবে গ্রহণ করে ফিরিয়ে দেয়। বিধবা মহিলাটি অক্ষত শরীরে মন্দির থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু এ ঘটনাটি লোকমুখে নরবলির কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়।
জনশ্রুতি আছে এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা গৌরলাল রায় চৌধুরী নামক এক নিঃসন্তান ভূস্বামী। তার বাড়ি মন্দির থেকে দুশ গজ পশ্চিমে। বাড়িটি ছোট দুর্গের মতো। বাড়ির চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু মাটির প্রাচীর এবং ২৫ ফুট প্রশস্ত গভীর জলাধার দ্বারা সুরক্ষিত। গৌরলাল রায় চৌধুরী মনোরঞ্জনের জন্য জলাধারে নৌকায় করে সেবিকা ও দাসীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। দুর্গটির পশ্চিম উত্তর ও দক্ষিণের প্রাচীরের কিছু অংশ এখনো আছে। পূর্বদিকের প্রাচীরটি কেটে ফেলা হয়েছে। দুর্গের ইট কিংবা ইমারতের চিহ্ন পাওয়া যায় না। চাষাবাদের সময় বা খননের সময়ও কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এমন ধারণা অস্বাভাবিক নয় যে, এটি কোনো রাজা সাময়িকভাবে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করতেন। মন্দির নির্মাণ কৌশলে মনে হয় এগুলো মোঘল আমলের তৈরি। তবে দেবী মন্দিরের বেদীতে পরিষ্কার বাংলায় যে ছয়টি নাম লেখা আছে তন্তুা সংস্কারের পর লিখিত হয়েছিল।
ভেমটিয়া শিবমন্দির
পীরগঞ্জ পৌরসভা থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে ভেমটিয়া নামক জায়গায় শিব মন্দির আছে। মন্দিরটি প্রায় তিনশত বছর পূর্বের। মন্দিরের পূর্বদিকে দেয়াল ধসে পড়েছে। দক্ষিণের দেয়ালে একটি দরজা আছে। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফুট।
মালদুয়ার দুর্গ
রানীশংকৈল উপজেলা হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণে একটি প্রাচীন দুর্গের সন্ধান পাওয়া যায়। দুর্গটির আয়তন প্রায় ২.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এক কিলোমিটার প্রস্থ। এর প্রাচীর মাটির তৈরি ও বাইরে জলাধারের চিহ্ন রয়েছে। দুর্গটির উত্তরাংশে যেখানে গ্রাম ও বাজার আছে সেখানে প্রাচীন ইট,মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ এবং প্রাচীন পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়। এগুলো থেকে অনুমান করে প্রত্নতাত্ত্বিক জনাব যাকারিয়া বলেছেন এখানে প্রাচীনকালে হিন্দু, বৌদ্ধ যুগের একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল।
গড়গ্রাম দুর্গ
রানীশংকৈল উপজেলার প্রায় তের মাইল উত্তরে নেকমরদ হাট ও মাজার। এখান থেকে প্রায় দু'কিলোমিটার উত্তরে গড়গ্রামে একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। দুর্গটির বাইরে পরিখা আছে। দুর্গের প্রাচীরগুলো মাটির। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫০০ মিটার এবং প্রস্থ ৩০০ মিটার। দুর্গটি ছোট হলেও বিচিত্র ধরনের। কারণ দুর্গটির ভেতরে আরেকটি ছোট দুর্গ ছিল যার অস্তিত্ব এখনো বোঝা যায়। দুর্গের বাইরে সন্নিকটে উত্তরে ইট পাথর ও বিভিন্ন প্রত্নবস্ত্ততে পূর্ণ একটি ঢিবি ছিল যা মূলত ইমারতের অস্তিত্ব বোঝায়। ধারণা করা হয় এখানে হিন্দু বৌদ্ধযুগের মন্দির জাতীয় কোনো ইমারত ছিল। এছাড়া দুর্গে মসৃণ কালো পাথর পাওয়া গিয়েছিল যা দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। পাথরটিতে সাপের পূর্ণফণার আকারে খোদিত রয়েছে পদ্মপাপড়ির কারুকার্য। এই অলংকরণ দশম একাদশ শতাব্দীর হতে পারে।
বাংলা গড়
রানীশংকৈল উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তরে এবং নেকমরদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পূর্বদিকে কাতিহার- পীরগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায় বাংলা গড় অবস্থিত। গড়ের ভিতর দিয়েই একটি পাকা রাস্তা পীরগঞ্জ রানীশংকৈলে চলে গেছে। গড়টির পশ্চিমদিকে এক বিশাল নদী প্রবাহিত ছিল যা এখন সম্পূর্ণ মৃত। মাটির প্রাচীর ও গভীর পরিখা দ্বারা গড়টি পরিবেষ্টিত। প্রবাদ আছে যে এখানে চাঁদ সদাগরের বাড়ি ছিল- বাসর রাতে লখিন্দরকে মনসাদেবীর কাল নাগিনী বাংলা গড়েই দংশন করেছিল।
গড়টির প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা খুব কঠিন। ধারণা করা হয় মুসলিম শাসন আমলের বহু বছর পূর্বে এটা নির্মিত হয়েছিল। ঝামা ইটের মত কালো রঙের ছিদ্রযুক্ত ইট ও নির্মাণ কৌশল দেখে গড়টিকে অত্যন্ত প্রাচীন বলে মনে হয়। অনুমান করা হয় যে, নেকমরদ অঞ্চল যারা শাসন করতেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গভীর অরণ্যের ভিতর এই গড় তৈরি করা হয়েছিল। মুসলমানদের আগমনের অনেক আগেই গড়টি জনশূন্য ও পরিত্যক্ত হয়।
হরিপুর উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্তের সন্নিকটে ভাতুরিয়া নামক গ্রামের কাছেই গড়ভবানীপুর। অনেকে মনে করেন এটি রাজা গণেশের ভাতুরিয়া পরগনার অন্তর্গত ছিল। রাজা গণেশ নিজে (১৪১৪-১৮ খ্রিঃ) গড়টি স্থাপন করেছিলেন। গৌড়ের সিং'হাসন লাভের পূর্বে তিনি এই অঞ্চলের প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। রাজা গণেশের মৃত্যুর পর তার হিন্দু বংশধররা ভাতুরিয়া গ্রামে বসবাস করতেন। আবার এমন ধারণাও প্রচলিত আছে যে, রাজা গণেশের রাজকর্মচারী দাহির কর্তৃক নির্মিত গড়টি গড়ভবানী নামে পরিচিত। রাম,মাধব,গোপাল ও যাদব নামে চার পুত্র ছিল। এই চারপুত্রের নামে চারটি খামার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এগুলো মৌজায় রূপান্তরিত হয়।
গড়টির দৈর্ঘ্য উত্তর দক্ষিণে প্রায় দেড় কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় এক কিলোমিটার। দুর্গের চারদিকে মাটির প্রাচীর দেখা যায়, যার উচ্চতা এখন আট ফুটের বেশি হবে না। গড়ের মাঝখান দিয়ে উত্তর দক্ষিণ বরাবর কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার পশ্চিমে একটি বেশ বড় ও গভীর দিঘি আছে। দিঘিটি 'তন্বী দিঘি' নামে পরিচিত। গড়ের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে কুলিক নদী প্রবাহিত। বর্তমানে নদীটির অবস্থা জীর্ণদশা। পশ্চিম এবং উত্তরে জলাধার ছিল। নদী এবং জলাধার দ্বারা দুর্গটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। গড়টিতে প্রাচীন ইমারতের কোনো ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি। তবে ইট ও মৃৎপাত্রের ভগ্ন অংশ এখনো কোনো কোনো জায়গায় পাওয়া যায়। পুকুরের নিকটে আছে একটি মাজারের ধ্বংসাবশেষ। এর কাছেই রয়েছে প্রাচীন গোরস্থান। গড় ভবানীপুরের সঠিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন। মাজারের ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হয় এটি মুসলিম শাসনামলে পুনরায় ব্যবহৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেছেন-' এ দুর্গটি এত অর্বাচীন নয়। খুব সম্ভব হিন্দু-বৌদ্ধযুগে এটি নির্মিত হয়েছিল।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বেলতলা গ্রামে গড়খাঁড়ি নামক একটি দুর্গ পাওয়া যায়। দুর্গটি তীরনই নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ৬০০ × ৪০০ মিটার আয়তনের দুর্গটির মাটির প্রাচীরগুলো বর্তমানে প্রায় ২০ ফুট উঁচু। গড়টির বাইরে প্রাচীর সংলগ্ন চারদিকে গভীর জলাধার ছিল এবং তার একটি মুখ তীরনই নদীর সাথে যুক্ত ছিল। দুর্গটিতে নদীপথে আসা-যাওয়ার জন্য এই মুখটি ব্যবহার করা হতো। হয়তো এর থেকে দুর্গটির বর্তমান নাম হয় গড়খাঁড়ি। গড়টিতে মাটির প্রাচীরের কিছু অংশ এবং প্রায় ভরাটকৃত জলাশয়ু ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না। দুর্গটির সময়কাল নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।এর সঠিক ইতিহাসও জানা যায় না। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা এটি সম্রাট শাহজাহানের সময় দ্বিতীয় দফা ব্যবহার করা হয়েছে। তার পূর্বে ধর্মরাজা নামক এক রাজার নিবাস ছিল এখানে। এসব থেকে ধারণা করা যায় দুর্গটি ধর্মপালের কোনো সেনা ছাউনি ছিল। দুর্গটি থেকে জগদল দু'কিলোমিটার দক্ষিণে।
কোরমখান গড়
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় এগার কিলোমিটার উত্তরে টাঙ্গন ব্যারেজ থেকে দু'কিলোমিটার পূর্বে কোরমখান গড়। সম্ভবত সুলতানি আমলে গড়টি নির্মিত হয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত। সম্রাটের প্রথম নাম খুররম থেকে কোরম শব্দটি এসেছে। মেজর শেরউইলের মানচিত্রে এ গড়কে বলা হয়েছে 'কোরমখান গড়'। ফ্রান্সিস বুকানন এর নাম উল্লেখ করেছেন 'মোঘলিকোট' হিসেবে।
কোরমখান গড় থেকে প্রায় দু'কিলোমিটার উত্তরে কোয়েলি রাজার দুর্গ। বর্তমানে এ দুর্গটি পঞ্চগড় জেলার অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় কামরূপের কোনো নৃপতি কোরমখান গড়ে সামরিক অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে কোয়েলি দুর্গ নির্মাণ করেন। মোঘল সাম্রাজ্য ও কুচবিহার সীমান্ত সংলগ্ন সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত সুরক্ষিত কোরমখান গড়টি বর্গাকৃতির এবং দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় এক কিলোমিটারের কাছাকাছি। দুর্গটির বাইরে চারদিক চল্লিশ ফুট প্রশস্ত ও গভীর পরিখা এবং বিশ ফুট উঁচু মাটির প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। আবার উত্তর ও দক্ষিণে বাইরের প্রাচীর থেকে ভিতরে প্রায় তিনশ ফুট দূরে আরো দু'টি করে পরিখা ও প্রাচীর রয়েছে। পশ্চিম প্রাচীর সংলগ্ন একটি বিরাট দিঘি আছে। দিঘির পূর্ব প্রান্তে ভূমিতে প্রাচীন ইমারতের প্রচুর ইটের টুকরা পাওয়া যায়। দক্ষিণের ভিতরের প্রাচীরে একটি প্রাচীন কূপ আবিষ্কৃত হয়। জানা যায় কূপটি মাটি ঢাকা ছিল এবং মাটির প্রাচীর কাটার সময় এটি স্থানীয় লোকজনেরা দেখতে পায়।
সাপটি বুরুজ
ঠাকুরগাঁও উপজেলার ভুল্লীহাট থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে সাপটি বুরুজ অবস্থিত। বুরুজ মূলত পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। মোঘল সাম্রাজ্য ও কুচবিহারের সীমান্ত এলাকা ছিল এ অঞ্চল।। মনে করা হয় মোঘলরা সীমান্ত পর্যবেক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে সাতটি বুরুজ তৈরি করেছিল। সাতটি বুরুজের একটি হলো সাপটি বুরুজ। সাতটি শব্দটি বিকৃত হয়ে সাপটি শব্দ হয়েছে। বুরুজটি বর্তমানে মাটির ঢিবিমাত্র। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু এবং শীর্ষদেশে ইটের টুকরা পাওয়া যায়। বুরুজটির নিকটেই একটি পুকুর আছে-তাকে সাপটি দিঘি বলে।
দিঘি
ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে প্রাচীনকালে বেশ কিছু নদী ও নিচু জলাভূমি ছিল। আর ছিল ঘন বন জঙ্গল। ফলে পতিত জমির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। তখন মানুষের মূল জীবিকা কৃষি কর্মবহুল। প্রাচীনকাল থেকে যেখানে নদী দূরে ছিল সেখানে জমির উর্বরতা বাড়াতে শুষ্ক মৌসুমে আবাদের জন্য এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পানির প্রয়োজন পূরণে প্রচুর দিঘি খনন করা হয়েছিল। রাজা, জমিদার বা তাদের প্রতিনিধিদের সহায়তায় জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে দিঘি খনন হয়। আবার কখনো স্থানীয় বাসিন্দারাও তাদের পানীয় সমস্যা মেটাতে এ ধরনের দিঘি খনন করেছিল। এসবের অনেকগুলো এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
ঠাকুরগাঁও জেলার উল্লেখযোগ্য দিঘিগুলো হলো-গড়েয়াহাট দিঘি, লস্করা দিঘি, টুপুলী দিঘি, শাসলা ও পেয়ালা দিঘি, ঠাকুর দিঘি(দানারহাট), আঠারো গান্ডি পোখর-ঠাকুরগাঁও উপজেলায়। আধার দিঘি, হরিণমারী দিঘি, রতন দিঘি, দুওসুও দিঘি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায়। রামরাই দিঘি, খুনিয়া দিঘি, রানীসাগর-রানীশংকৈল উপজেলায়। মেদিনীসাগর দিঘি হরিপুর উপজেলায়। রানীশংকৈলের রামরাই দিঘি ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ । দিঘিটি পাঁচশ থেকে হাজার বছরের পুরাতন হতে পারে। এর সঠিক ইতিহাস জানা যায় না।
প্রায় দুশ বছর আগে স্থানীয় কোনো জমিদার খনন করেছিল খুনিয়া দিঘি। জনশ্রুতি আছে এই এলাকার ব্যবসায়ীরা দিঘির পাশ দিয়ে ব্যবসা করতে রায়গঞ্জে যেতেন। দিঘির এলাকাটি নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। এখানে এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দিঘির পাড়ে ফেলে রেখেছিল। তখন থেকে দিঘির নাম খুনিয়া দিঘি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক বাহিনী বহু বাঙালিকে হত্যা করে এই দিঘিটিতে ফেলে রাখে। এখানেই খুনিয়া দিঘির বর্তমান নামকরণের ভয়ঙ্কর সার্থকতা।
'আঠারো গান্ডি পোখর'-আঞ্চলিক উচ্চারণ। মূলত আঠারো গন্ডা পুকুর অর্থাৎ পর পর একসাথে বাহাত্তরটি পুকুর রয়েছে ঠাকুরগাঁও উপজেলার দানারহাট এলাকায়। এর অনেকগুলো দিঘি এখন জীর্ণশীর্ণ। আঠারো গন্ডা পুকুর কবে কে খনন করেছিল তা বলা কঠিন। কিন্তু এতগুলো পুকুর খননে মনে হয় কোনো নৃপতির সহযোগিতায় এ কাজটি হয়েছিল। আর এত খননকৃত জলাশয়ের কারণে সহজেই বোঝা যায় এখানে কোনো প্রাচীন জনপদ ছিল। এগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য দিঘি-পুকুর ছড়িয়ে রয়েছে ঠাকুরগাঁও জেলায়।
রচনায়: বেলাল রববানী
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS